শিকলে বাঁধা বন্দী জীবন প্রতিবন্ধী কিশোরীর
চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু
২৩ এপ্রিল সোমবার। সকাল তখন ৯ টা। পাবনার চাটমোহর হাসপাতাল গেট এলাকায় গলায় লোহার ভারী শিকল ও তালা লাগানো এক কিশোরীর গাড়ির জন্য অপেক্ষা নজর কাড়ল। পাশেই তার অভিভাবিকা। বৃদ্ধ মহিলা। নুয়ে পরেছে বয়সের ভারে। কাছা কাছি যেতেই কিশোরীর মুখে অভিযোগের সুর। “গাড়িত আমারে লিচ্ছে না। ইটু কয়া দ্যান। তালি লিবিনি”। মেয়েটি মানসিক বা শারিরিক প্রতিবন্ধী কিনা তা তখনও বুঝে ওঠা কঠিন হলেও পাশের লেগুনা চালক কেন তাদের নিচ্ছে না জানতে চাইলে লেগুনা চালক বলেন, “ও পাগল। গাড়িত বাথরুম কর্যা ফালাবিনি”। এবার ও প্রতিবাদী কন্ঠ কিশোরীর। “আমি গাড়িত বাথরুম করি না”। পাশের থেমে থাকা লেগুনায় হাতের ভর করে দাড়ায় কিশোরী। মাথার ছোট ছোট চুলগুলো ওড়নায় অর্ধেকটা ঢাকা। গলার সাথে ঝোলানো লম্বা লোহার শিকলের অন্য পাশ তালাসহ হাতের মুঠিতে শক্ত করে ধরেছে মেয়েটি। নাম কি তোমার ? বৃষ্টিয়ারা। নাম বলে কিছুক্ষনের জন্য থামে মেয়েটি। পাশেই বয়সের ভারে ঝুলে পরা চামড়া ওয়ালা ঐ বৃদ্ধা অভিভাবিকা অসহায় এর মতো বসে পরেন । তার চোখে মুখে ক্লান্তি ও দুশ্চিন্তার ছাপ। তিনি বলেন, “আমি বুরহান মিস্ত্রীর মা। বাড়ি ধানকুনে। বাড়িত যাবো তা উড়া লিচ্ছে না”। লেগুনা চালক এবার বলেন, “ভাই ওগারে একটা অটো ভ্যানে তুল্যা দিচ্ছি। আপনে যান”। ব্যস্ততা থাকায় সেখান থেকে দ্রুত গন্তব্যে রওনা দেই। পরে জানতে পারি বৃষ্টিয়ারা ও তার অভিভাবিকা নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছেছে।
৪ এপ্রিল মঙ্গলবার বৃষ্টিয়ারা ও তার ঐ অভিভাবিকার সন্ধানে চাটমোহর পৌর সদর থেকে ৫ কিলোমিটার উত্তরের গ্রাম ধানকুনিয়ায় পৌছে বৃষ্টিয়ারার কথা ও বর্ণনা দিতেই ওদের বাড়িতে যাবার রাস্তা দেখিয়ে দেন এলাকার এক প্রবীণ ব্যক্তি। মানুষের বাড়ির উপর দিয়ে কোনমতে পায়ে হাঁটা পথে ঝোঁপ ঝাঁড়ের মধ্য দিয়ে যখন ওদের বাড়ি পৌছি তখন সকাল দশটা। পাশেই গুমানী নদী। পলিথিনের ছাউনির ঝুঁপড়ির নিচে চুলোর পাশে বসে বৃষ্টিয়ারা ও তার অভিভাবিকা তখন আলু ও ঢেড়শ সিদ্ধ দিয়ে সকালের খাবার খাচ্ছিলেন। পাশেই ভাতের খোলা পাতিল। প্লাষ্টিকের ভাঙ্গা বালতিতে আয়োডিন বিহীন মোটা লবণ। বৃষ্টিয়ারার গলায় তখনো ঝুলছিল লোহার সেই শিকল ও তালা।
“আমাক মাদ্রাজ লিয়্যা যাব্যান। মাদ্রাজ গেলি বেলে আমি ভাল হয়া যাবো! আমাক লিয়া যাব্যার আইছ্যান? চুলোর সামনে দাঁড়াতেই বৃষ্টিয়ারার এমন অনেক জিজ্ঞাসা। বৃষ্টিয়ারা স্বজনদের কাছ থেকে জানা যায়, মানসিক প্রতিবন্ধী বৃষ্টিয়ারার পুরো নাম শুকজান খাতুন। বয়স ১৫ বছর। বাবার নাম মনিরুল ইসলাম। মা মৃত রোজিনা খাতুন। ষোল-সতেরো বছর আগে ধানকুনিয়া গ্রামের রহমানের মেয়ে রোজিনা খাতুনের বিয়ে হয় চাটমোহরের হরিপুর ইউনিয়নের ধূলাউড়ি গ্রামের মনিরুলের সাথে। তেরো-চৌদ্দ বছর আগে মনিরুল রোজিনাকে ডিভোর্স দেয় এবং দ্বিতীয় বিবাহ করে সেই স্ত্রীকে নিয়ে ধুলাউড়ি গ্রামে বসবাস করছে। বৃষ্টিয়ারা তখন কোলের শিশু। পিতার বাড়িতে আশ্রিত হওয়ায় রোজিনার পিত্রালয়ের কেউ কেউ কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন রোজিনাকে গাল মন্দ শুরু করে। কিছু দিন পর রোজিনা মৃত্যুবরণ করে। এটি এগারো-বারো বছর আগের কথা। রোজিনার মা (বৃষ্টিয়ারার নানী) জাহানারা ও জীবিত নেই। বৃষ্টিয়ারার নানা রহমান বসবাস করছেন বিলচলন ইউনিয়নের রামনগর গ্রামে। বাবা, নানা, সৎ মা কারো দয়া ভালবাসা জুটছে না প্রতিবন্ধী কিশোরী বৃষ্টিয়ারার কপালে। রোজিনার দাদী (রহমানের মা) প্রায় অচল রাহেলা খাতুন (৯০) এখন দেখাশুনা করছেন বৃষ্টিয়ারাকে। শিশু অবস্থা থেকেই বৃষ্টিয়ারা তার কাছে বড় হচ্ছে।
রাহেলা খাতুনের তিন ছেলে। রহমান, সেবাহান ও বোরহান। এদের যার যার মতো আলাদা সংসার। বৃষ্টিয়ারার মতো রাহেলার দায়িত্ব নেবার ও কেউ নেই। জমা জমি কিছুই নেই। উপার্জনক্ষম অন্য কেউ নেই তার। সামান্য কিছু বিধবা ভাতা পান। তা দিয়েই চলছে এ দুটি প্রাণ। বৃদ্ধা রাহেলা বলেন, “খুব কষ্টে লাতিনির প্রতিবন্ধী মিয়্যাডাক পালন করছি। শেকল খোলা পালিই পলায়া এ গাও ও গাও চল্যা যায়। আমি বুড়ি মানুষ। নিজিই চলব্যার পারি না। ওক এ গাও ও গাও থেক্যা খুঁজ্যা আনা আমার পক্ষে কঠিন হয়া পরে। এরম ও হইছে এক দিনিই দুই তিনব্যার পলায়া চ্যাল গ্যাছে। কোন কোন সময় তালা ভাঙ্গ্যা পলায়া যায়। এতোরকার যারা চেনে ওক তারা বাঁধ্যা রাখে। আমাক খবর দেয়। আমি যায়া লিয়ে আসি। রাতি ঘুম পারার সময়ও ওক ঘড়ের খুটির সাথে তালা দিয়া রাখা লাগে। ওর মাথায় সমস্যা। টেকা পয়সা নাই আমার। বাপে ও ধার ধাওে না। আমি ওর চিকিৎস্যা করাব্যার পারি না। ও যখন খাড়া (দাঁড়িয়ে) থাকে তখন সবসময় দুই হাত লড়ায়। গাও (শরীর) ঢোলে”।
জন্মগত ভাবে প্রতিবন্ধী হওয়ায় বৃষ্টিয়ারার নানার অন্য দুই ভাইয়ের স্ত্রী সন্তানেরা যতটুকু সম্ভব সাধ্যমতো দেখে রাখেন মেয়েটিকে। রাহেলার পাটকাঠির ভাঙ্গা বেড়ার ঘরে এভাবেই দিন রাত কাটছে শিকলে বন্দী প্রতিবন্ধী বৃষ্টিয়ারার। চিকিৎসার অভাবে বৃষ্টিয়ারার অতীতের দিনের মতো আগামী দিনও যেন কালো মেঘে ঢাকা। সুচিকিৎসা পেলে ভালও হতে পারে মেয়েটি। কিন্তু এ দায়িত্ব নেবে কে?