প্রসঙ্গ: সিটিজেন জার্নালিজম

সিলভানুস লামিন

ভূমিকা
নিকট অতীতে সংবাদের জন্য আমরা প্রথমে রেডিও, পত্র-পত্রিকা এবং পরবর্তীতে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর মুখাপেক্ষী হতাম। কোন রাজনৈতিক সংবাদ, খেলার সংবাদ কিংবা বিনোদন সংবাদের জন্য এসব সংবাদ মাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল ছিলাম। কিন্তু আজ সেই নির্ভরশীলতা অনেকটা কমে গেছে। প্রযুক্তির উৎর্কষের সুফল আমরা আজ সবাই ভোগ করেছি। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আসার পর থেকেই আমরা সেকেণ্ডেই বিভিন্ন সংবাদ পেয়ে থাকি, নিজেকে তথ্য দিয়ে সমৃদ্ধ করেছি এবং অনেকক্ষেত্রে বিনোদনও লাভ করেছি। আজ অনেকে বিভিন্ন ব্লগ, ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, লিঙ্কডিনসহ নানান সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন ধরনের সফট ও হার্ড নিউজ পরিবেশন করেন। কোন কোন ক্ষেত্রে ব্রেকিং নিউজগুলোও প্রথমে এ সোশ্যাল মিডিয়াতেই প্রকাশ বা সম্প্রচার হয় প্রথম। এই যে আমরা যারা এতদিন সংবাদভোক্তা হিসেবে পরিচিত ছিলাম আজ আমরা নিজেরাই সংবাদ পরিবেশক বা প্রতিবেদক হিসেবে আর্বিভূত হয়েছি। আমাদের দ্বারা এসব সংবাদ পরিবেশনা বা প্রচার করার রূপকেই আমরা সিটিজেন জার্নালিজম বা সাংবাদিকতা বলতে পারি। সিটিজেন জার্নালিজম একদিকে যেমন একটি ‘সুযোগ’ অন্যদিকে এটি একটি ‘সমস্যা’ হিসেবেও চিহ্নিত করা যেতে পারে। এটিকে সুযোগ হিসেবে বলা যেতে পারে কারণ সংবাদ পরিবেশনায় একটি গণতান্ত্রিক চর্চার পথকে উন্মোচিত করে। সংবাদ এখন আর সংবাদ মাধ্যমগুলোর একচেটিয়া পণ্য নয়। অন্যদিকে এটিকে সমস্যা বলা যেতে পারে কারণ সিটিজেন জার্নালিস্টরা কোন ‘কোড অব কন্ডাক্ট’ মানে না, সংবাদ নীতিমালা অনুসরণ করে না, সংবাদগুলো ফিল্টার হয় না এবং অনেকসময় সংবাদগুলো নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে আহরিত নয়। ফলশ্রæতিতে সমাজে বিশৃঙ্খলা আনতে পারে।

সিটিজেন জার্নালিজম: একটি সুযোগ
সিটিজেন জার্নালিজমকে একটি সুযোগ হিসেবে দেখেছেন অনেকে। কারণ সাধারণ মানুষেরা প্রচলিত গণমাধ্যমের সংবাদব্যবস্থাপনায় অবদান রাখতে পারছেন। সাধারণ মানুষেরা সংবাদ সংগ্রহ, প্রচার এবং ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করেন; তারা নিজেরাই এক একজন সাংবাদিক। সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনা না করেও তারা প্রতিনিয়ত নানান ধরনের সংবাদ পরিবেশন করেন। সিটিজেন জার্নালিজম কল্যাণে আমরা আজ সবাই যেমন সংবাদভোক্তা তেমনি সংবাদ পরিবেশকও। সিটিজেন জার্নালিস্টরা মূলত ফেসবুক, ইউটিউবসহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়াতে আধেয়, ছবি, ভিডিও আকারে এসব সংবাদ পরিবেশন করে থাকেন। সিটিজেন জার্নালিস্টরা যেসব সংবাদ বা তথ্য পরিবেশন করে সেটা মূলত ডিজিটাল ফর্মে থাকে। এভাবে দেখা যায়, সংবাদ পরিবেশনায় সাধারণ মানুষেরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন এবং সংবাদব্যবস্থাপনায় তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়। আমরা যদি ফেসবুক বা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাবো সারাদিন অসংখ্য সংবাদ, বিনোদন, উদ্যোগ, ঘটনা সাধারণ মানুষেরা সহভাগিতা করেন, প্রচার করেন বা সম্প্রসারণ করেন। এসব সংবাদ, ঘটনা বা উদ্যোগ অনেকক্ষেত্রে অনেকের উপকারে আসে, অনেকে সেখান থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য লাভ করেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোন এলাকায় আগুন লাগলে সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শী সিটিজেন জার্নালিস্টরা সেটা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার বা প্রকাশ করেন। এতে করে দ্রুত সেখানে প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা হাজির হতে পারেন এবং দ্রুত আগুন নিভাতে পারেন এবং ক্ষয়ক্ষতি কম হয় বা প্রাণহানীর ঘটনা কমে যায়! অন্যদিকে কোন এলাকার ভালো কোন উদ্যোগও দ্রুত সবার নজরে চলে আসে সিটিজেন জার্নালিস্টদের কল্যাণে। এসব ভালো উদ্যোগ দেখে অন্যরাও উৎসাহিত হয়; অনুপ্রেরণা লাভ করে। এরকমই অনেক উদাহরণ রয়েছে যেখানে সিটিজেন জার্নালিজম সমাজে ভালো অবদান রেখেছে। এছাড়া প্রচলিত গণমাধ্যমের পেশাদার সাংবাদিকরা তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য অনেকসময় সেই সোশ্যাল মিডিয়াতে সংগ্রহ করেন। ২০১৬ সালের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, বর্তমানে ৫০% এর বেশি পেশাদার সাংবাদিক তাদের প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন। অন্যদিকে কোন পেশাদার সাংবাদিক একটি বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করলে সাধারণ মানুষেরা সেই প্রতিবেদনকে আরও সমৃদ্ধ, তথ্যবহুল ও প্রাসঙ্গিক করার জন্য বিভিন্নভাবে তথ্য সহযোগিতা করতে পারে। পেশাদার সাংবাদিকরা এসব তথ্য পেয়ে তাদের প্রতিবেদনগুলো আপডেট করতে পারেন।

সিটিজেন জার্নালিজম: একটি সমস্যা
সিটিজেন জার্নালিজমের নানান ভালো দিকে থাকলেও এর কিছু সমস্যা রয়েছে। প্রচলিত গণমাধ্যমের অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন সিটিজেন জার্নালিজম পেশাদার জার্নালিস্টদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। তারা মনে করেন, সিটিজেন জার্নালিস্টরা যেসব সংবাদ পরিবেশন করেন সেগুলোর নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অনেক সময় ভুল তথ্য পরিবেশিত হতে পারে। এতে করে নানান বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে সমাজে। অন্যদিকে সিটিজেন জার্নালিস্টরা সাংবাদিকতার নীতিমালা সম্পর্কে কোন ধারণা রাখেনা। ফলশ্রুতিতে এমন কিছু ছবি, ভিডিও বা আধেয় পরিবেশন করেন যার মাধ্যমে নানান বিতর্ক ও অসন্তোষ দেখা দিতে পারে সমাজে-রাষ্ট্রে। এছাড়া এসব সংবাদ কখনও ফিল্টার করা হয় না; ফলে এর মান নিয়েও নানান প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। অন্যদিকে সিটিজেন জার্নালিজমের সংবাদ রূপটি অনেকটা ডিজিটাল। এর ডিজিটাল সংবাদ প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের কাছে পৌছে না। প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের স্বার্থ ও কল্যাণ এই সিটিজেন জার্নালিজম মাধ্যমে প্রতিফলিত হয় কম।

সিটিজেন জার্নালিজম: মূলধারার গণমাধ্যমের সহযোগী
সিটিজেন জার্নালিজমের কিছু খুঁত থাকলেও একটি মূলধারার গণমধ্যমের ‘সহযোগী’ হিসেবে ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। অনেক গণমাধ্যম পণ্ডিত ও বিশেষজ্ঞরা মনে করে, সিটিজেন জার্নালিজম মূলধারার গণমাধ্যমকে নানানভাবে সহযোগিতা করে। কারণ মূলধারার গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা দেশের প্রতিটি জায়গায় এলাকায় থাকেন না; কিন্তু সাধারণ মানুষেরা বা নাগরিকগণ থাকে। সিটিজেন জার্নালিস্ট ও মূলধারার গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা একযোগে কাজ করলে ভালো ও মানসম্মত আধেয় তৈরি করতে পারেন। অন্যদিকে সিটিজেন জার্নালিস্টরা যেসব ছবি, সংবাদ, ভিডিও তৈরি করেন সেগুলোও মূলধারার গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা সম্পাদনা করে একটি মানসম্মত প্রতিবেদন তৈরি করতে পারেন। প্রকৃতপক্ষে সিটিজেন জার্নালিজম আসার পর থেকে মূলধারার গণমাধ্যমের সংবাদ পরিবেশনা, তথ্য সংগ্রহ এবং প্রতিবেদন তৈরি আরও সহজ হয়েছে। সাধারণ মানুষের তথ্যগুলো তারা হাতের কাছেই পেয়ে যান। এতে করে তারা যেকোন বিষয় নিয়ে ‘স্টোরি’ করলে দেশের প্রায় সব এলাকার তথ্যগুলো সেখানে সন্নিবেশিত করতে পারেন, যা তাদের প্রতিবেদনকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলে।

happy wheels 2

Comments