নেপালে প্রশিক্ষণ; শিখন, অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা

নেপাল থেকে ফিরে অর্পণা ঘাগ্রা:

২৭ ফেব্রুয়ারি-৫ মার্চ ২০১৭ পর্যন্ত  REGIONAL LEARNING PLATFORM FOR FACILITATING CHANGE PROCESSES TOWARDS FOOD SOVEREIGNTY-এর উপর হোটেল ভিউ ভ্রিকুটি, ললিতপুর, কাঠমুন্ডু, নেপালে ৭দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হওয়া প্রশিক্ষণের কিছু শিখন, অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা সহভাগিতা করবো এই লেখার মাধ্যমে। এই প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেছে ৪টি (বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, নেপাল) দেশের ২২টি ভাষার ৭টি সংস্থার (বারসিক, কারিতাস ইন্ডিয়া, কারিতাস নেপাল, এমপি ফোরাম, সোসাল ওয়ার্ক ইনস্টিটিউট, ফুড সভারেন্টি এলায়েন্স, রুটস ফর ইকুইটি) প্রতিনিধিবৃন্দ। বারসিক থেকে সৈয়দ আলী বিশ্বাস, মো.  তৌহিদুল আলম এবং আমি অর্পণা ঘাগ্রাসহ তিনজন অংশগ্রহণ করি। এই প্রশিক্ষণে যাওয়ার মধ্য দিয়েই আমার জীবনের প্রথম দেশের বাইরে যাওয়া। তাই বিমান ভ্রমণ থেকে শুরু করে প্রশিক্ষণের প্রতিটি সেশনে যা ছিল এবং প্রশিক্ষণের বাইরে বিভিন্ন দেশের মানুষের সাথে পরিচয় ও মিশে যাওয়া সব কিছুই ছিলো আমার জন্য অত্যন্ত ভালো লাগার, আগ্রহের এবং শেখার।

Opro1
প্রশিক্ষণের পরিবেশ ও ফেসিলিটেশন পদ্ধতিগুলো ছিল একদমই ব্যতিক্রম, যা সবকিছুকে সবার কাছে সহজ করে দিয়েছিল। সহায়কেরা সব সময় শুধু সহায়কের ভূমিকাই পালন করেনি; সারাদিনে তাঁরাও অনেকবার অংশগ্রহণকারী আবার অংশগ্রহণকারীরাও অনেকবার সহায়কের ভূমিকা পালন করেছেন। এ যেন সবাই সবার কাছ থেকে সবার শেখার মঞ্চ। এই ব্যতিক্রমী প্রশিক্ষণে যা কিছু মুখে বলা হয়েছে তার সব কিছুই দৃশ্যায়মান করা হয়েছে। এগুলো আমার কাছে একদমই নতুন উদাহরণ, যা আমি আদর্শ শিক্ষণ হিসেবে গ্রহণ করেছি।

প্রশিক্ষণের তৃতীয় দিনে আমরা দু’টি দলে বিভক্ত হয়ে কাঁচা বাজার পরিদর্শন করতে যাই। ১০ জনের গ্রুপের মধ্যে আমি, তৌহিদ ভাই (মো. তৌহিদুল আলম) একই দলে ছিলাম। আমরা যে বাজারে গিয়েছিলাম সেই বাজারের নাম ভালকু কৃষি তথ্য তরকারি বাজার। সেখানে প্রায় (৫০০)টি সবজি দোকান আছে। সবজি ব্যবসায়ীদের মধ্যে নারী ও পুরুষের সম্পৃক্ততা প্রায় সমান। বাজারে অনেক ধরনের স্থানীয় শাকসবজি ছিল, যা আমাদের দেশ থেকে ভিন্ন; যেমন রুখ টমেটো, ঘিউ শিমি, ইসকুস, লাফসি, চমশুর শাক, খলে শাক, রাইও শাক, বকুল্লা, বাডি প্রভৃতি। দোকানিরা জানান এগুলো ছাড়াও অনেক সবজি আছে যেগুলো ভারত থেকে আসে। তার মধ্যে বেগুণ, টমেটো, মূলা, গাজর, পেঁয়াজ, রসুন প্রভৃতি। উল্লেখ্য যে, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সবজিগুলো ফরমালিন মুক্ত। অপর আরেকটি গ্রুপ অন্য আরেকটি বাজার পরিদর্শন করার পর তাদের উপস্থাপনে উল্লেখ করেন বাইরে থেকে আসা সবজিগুলোর মধ্যে বেগুন, টমেটো, করলা জাতীয় সবজিগুলোতে এবং মাছে বেশি ফরমালিন পাওয়া যায়। তবে তাদের কালেকশন সেন্টারে ফরমালিন পরীক্ষা করার ল্যাব আছে।

পরের দিন ৪টি গ্রুপ ৩টি গ্রাম পরিদর্শনে বের হই। তার মধ্যে আমরা কোটডাডা গ্রাম পরিদর্শন করি। আমি, তৌহিদ ভাই (মো. তৌহিদুল আলম) কারিতাস ইন্ডিয়া হতে কালিচরণ মারান্ডি, পাকিস্তান থেকে নাভিদ আহমেদ ও সোসাল ওয়ার্ক ইনস্টিটিউট নেপাল  থেকে একজন প্রতিনিধির নাম ভদ্রি প্রসাদ আমাদের সহায়ক হিসেবে ছিলেন। এই গ্রামে ৩২জন সদস্যের একটি কৃষি সংগঠন আছে। প্রথমেই তথ্য সংগ্রহ করার জন্য আলোচনা করা হয় সংগঠনের ১০ জন সদস্যদের সাথে ও স্থানীয় প্রবীণদের সাথে। আলোচনা সূত্রে জানা যায়, এই গ্রামে প্রায় ১০৪টি পরিবার ও প্রায় ৫২০জন জনসংখ্যা আছে। তাদের প্রধান পেশা কৃষি। অধিকাংশ পরিবারের জমির পরিমাণ কম ও ছোট ছোট আকারের জমি। পাহাড়ের ঢালু জমিতে তারা ফসল উৎপাদন করে। বারিস (বর্ষা) মৌসুমে সিমি (শিম), গরি, কিস্তরি, মকাই, কদসাস (সয়াবিন), কাকরো, কাররো (শশা), রাজমা সিমি (শিম) প্রভৃতি উৎপাদন করে। শুকনা মৌসুমে মূলা, রাইও শাক, রাটি, টরি, সরিষা, গম, পেয়াজ, রসুন, ধনিয়া, আলু, রুখ টমাটো, ব্রুকলি, ফুলকপি, পাতাকপি প্রভৃতি উৎপাদন করে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, কম পরিমাণের একই জমিতেই তারা প্লট আকারে কয়েক ধরনের ফসল চাষ করে পারিবারিক চাহিদা পূরণ করছেন  এবং একইসাথে কৃষি প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

Orpo
তারা জানিয়েছেন কোদাল ও নিরানি জাতীয় উপকরণ দিয়ে মাটি কুপিয়ে জমি প্রস্তুত করেন। পূর্বে জৈব সারের ব্যবহার বেশি থাকলেও বর্তমানে তারা রাসায়নিক সার ও কিটনাশক ব্যবহার করছেন। তবে যারা পারিবারিক খাদ্য চাহিদা পুরণের জন্য চাষ করেন তারা জৈব পদ্ধতিতে চাষ করেন। তারা জানান, প্রকৃতিতে ফসলের অনেকগুলো উপকারী (গাড়িওয়ালা, বুড়ি, ধুশি, কবেটে, কেচেঁ প্রভৃতি) পোকা আছে। তার মধ্যে সাপ একটি। কারণ সাপ দূষিত বাতাস খেয়ে বাতাসকে বিশুদ্ধ করে। পূর্বে বীজ নিজেরা সংরক্ষণ করলেও বর্তমানে বাজারের উপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে। তবে এখনও কেউ কেউ বীজ সংরক্ষণ ও বিনিময় করেন। শুকনো মৌসুমে পানির সমস্যা রয়েছে তাদের। রাস্তার বিভিন্ন স্থানে পানির ট্যাব আছে। একই পানি তারা দুইভাবে ব্যবহার করেন। ট্যাবের কাছে তাদের ব্যবহার করা পানি ড্রেনের মাধ্যমে তারা ফসলী জমির এক কোনে ছোট আকারের গর্ত করে জমিয়ে রেখে পরবর্তীতে তা সবজির জন্য ব্যবহার করেন। গর্তের পানিই চুইয়ে চুইয়ে মাটিকে ভিজিয়ে রাখতে সাহায্য করে।

মায়া মিসটার নামক কৃষাণী সবজি চাষ করেছেন লোকায়ত পদ্ধতিতে। বাড়ির সামনে খুবই ছোট পরিমাণ জমিতে প্লট আকারে তিনি  সবজি চাষ করেছেন। তার মধ্যে জমির একাংশ তুলনামূলকভাবে পাথুরে জমি। কিন্তু সেই জায়গাটিরও তিনি যথোপযুক্তভাবে কাজে লাগিয়েছেন মল পদ্ধতি ব্যবহার করে। মল তৈরির জন্য তিনি নারকেলের ছোবরা, সরিষার পুরনো গাছগুলো ধাপে ধাপে বসান প্রায়  ২ ফুট উচু করে। পরবর্তীতে এটি পচে সার হলে পর তার উপর কেরো (লাই শাক) শাকের বীজ বপন করেন। এই পদ্ধতির মাধ্যমে তিনি পাথুরে জমির যথোপযুক্ত ব্যবহার করেন এবং পারিবারিক খাদ্য চাহিদা পুরন করছেন।

শুকনো মৌসুমে গবাদি পশুর জন্য খাদ্য সংকটে পড়তে হয় তাদের। তাই কিছু কিছু কৃষক গবাদি পশুর জন্য জাই নামক এক ধরনের ঘাস চাষ করেন। এই ঘাসের উচ্চতা প্রায় ২-৩ ফিট। গবাদি পশুর জন্য উৎপাদন করা হলেও এই ঘাসে সরিষা দানার মতো ফলন হয়। এটি শুকিয়ে গুড়ো করে তারা পিঠা তৈরির কাজে ব্যবহার করে থাকে।
আরেক উদ্যোমী কৃষাণী আশা খরকর বাণিজ্যিকভাবে ২টি জাতের কাউলি (ফুল কপি) চাষ করেন। ফুল কপির চারা উৎপাদন করেন ট্রে আকৃতির বিশেষ পাত্রের মধ্যে। এই পাত্রে ছোট ছোট ১৫০টি ঘর আছে। তাই একটি পাত্রেই ১৫০টি চারা গজানো সম্ভব। প্রত্যেকটি ঘরে নারকেলের ছোবরা, ঘাসের লতাপাতা দিয়ে তৈরি করা শুধু জৈব সার দিয়ে ভরাট করে চারা উৎপাদন করেন। তার সবজি বাগানের পাশে পাহাড়ি গাছের বাগান আছে। বাগানের মাঝে টুকটুকে লাল রঙের ফুল ফুটে আছে। ফুলটি ছিড়ে ফুলের পাপড়ি তিনি আমাকে খেতে  দেন। খেয়ে দেখি এর স্বাদ টক। অনেকটা গারো আদিবাসীদের প্রিয় সবজি মেন্দা চুকাই পাতার স্বাদের মত। তখন আমার সর্দি কাশি হচ্ছিল। এটা খাওয়ার পর অনেকটা স্বস্তি পেয়েছিলাম। তিনি জানান, ফুলের নাম লালগোরাস। এটি নেপালের জাতীয় ফুল। এটি সর্দি ও কাশির জন্য ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করেন। কেউ কেউ সবজি হিসেবে ব্যবহার করেন। অনেকে জুস তৈরি করে খান। আবার অনেকে শুকিয়ে গুড়ো করে বোতলে সংরক্ষণ করেন। বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাও এর ব্যবহার ও উপকারিতা সম্পর্কে জানেন। কারো সর্দি ও কাশি হলে তারা স্কুলে গেলেও সাথে রাখেন। এটি জঙ্গলে জন্মে। ফুলের রঙ লাল টুকটুকে। তাই এর নামকরণ করা হয়েছে লালগোরাস। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে ফুল ফুটে। মার্চ-এপ্রিল মাসে ফল হয়। ফলও খাওয়া যায়। গাছ অনেক বড় হয়।

Orpo2
কোটডাডা গ্রামের ৮৩ বছর বয়সের প্রবীণ কাঞ্চু মাগার নি আমাদের জানান, আজ থেকে প্রায় ৪০-৫০ বছর পূর্বে পাহাড়ে কোন বড় গাছ ছিলো না। শুধু ঝোপ জঙ্গল ছিলো। অনেক বন্য প্রাণী ছিল। তখন মাটির উর্বরাশক্তি যথেষ্ট ভালো ছিল। বর্তমানে পাহাড়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মাধ্যমেই সরকার বনায়ন করেছেন। তার মধ্যে গটো নামক এক ধরনের গাছ আছে। যার ছাল ছেঁচে আঠা বের করে গাম তৈরি করা হয় ও গাছ কাঠ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। গাছটি দ্রুত বর্ধনশীল। অন্য আরেকটি গ্রুপের গ্রাম পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা সহভাগিতা থেকে জানতে পারলাম যে, স্থানীয় জনগোষ্ঠী এই গাছটিকে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর মনে করছেন। কারণ গাছটি খুব বেশি পানি শোষণ করে। গাছটি দেখতে আমাদের দেশের ঝাউ গাছের মত।

নেপালে অনেকগুলো দর্শনীয় স্থানের মধ্যে আমাদের দেখার সুযোগ হয়েছে পুরনো রয়াল প্যালেশ, পশুপতি মন্দির, মাংকি টেম্পল, কুমারি মন্দির ও বিভিন্ন মার্কেট। মার্কেটে ব্যবসার ক্ষেত্রে নারীদের সম্পৃক্ততা উল্লেখযোগ্য। শুধু মার্কেট ও অন্যান্য ক্ষেত্রেই নয় পারিবারিক খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য শাক সবজি উৎপাদন, পরিচর্যা, বীজ সংরক্ষণ, বীজ বিনিময় প্রভৃতি ক্ষেত্রে নারীরা সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত, যা আমাদের দেশের কৃষাণীদের সাথে মিল আছে। আরো মিল আছে সাধারণ ও ক্ষুদ্র কৃষকদের উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থায় প্রবেশাধিকার এবং ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হওয়ার দিক থেকেও। তাই তাদের অধিকার সমুন্নত রাখতে তাদের স্ব স্ব ভূমিতে ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে তাদের পছন্দ, চাহিদা, সিদ্ধান্ত, প্রযুক্তির ব্যবহার ও মতামতের অধিক গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। যেন  প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বজায় রেখে খাদ্য সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করার পথ সুগম হয়।

happy wheels 2

Comments