আমিও চলতে ফিরতে চাই
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
প্রতিবন্ধি ব্যক্তি হলেন তারা যাদের দীর্ঘ মেয়াদী শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিগত বা ইন্দ্রিয়গত অসুবিধা রয়েছে। যা নানান প্রতিবন্ধকতার সাথে মিলে মিশে সমাজে অন্যান্যদের সাথে সমতার ভিত্তিতে তাদের পূর্ণ ও কার্যকর অংশগ্রহণে বিঘœ ঘটায়। স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে যাদের স্বাস্থ্যগত অবস্থা ভিন্ন, অঙ্গহানি, কর্মকাণ্ড সম্পাদনে সীমাবদ্ধতা ও অংশগ্রহণে বাধা সেই সব মানুষই প্রতিবন্ধি হিসেবে চিহ্নিত।
প্রতিবন্ধিতার বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে। তবে বাচ্চার জন্মের সাথে সাথেই এই লক্ষণ প্রকাশিত হয়না। বিভিন্ন গবেষক বা ডাক্তারগণ দীর্ঘদিন গবেষণা করে এর কারণসমূহ চিহ্নিত করেছেন। যখন কোনো পরিবারের শিশুটির মাঝে প্রতিবন্ধিতার বিভিন্ন লক্ষণ প্রকাশিত হয় তখন থেকেই শুরু হয় পরিবার এবং সমাজে তার প্রতি অসংবেদনশীল আচরণ। লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের অন্তর্গত দরুন হাসামপুর গ্রামের আরমান আহম্মেদ একজন শারীরিক প্রতিবন্ধি শিশু। বয়স ৯ বছর। সে কথা বলতে পারে তবে অস্পষ্ট। মুখ থেকে লালা ঝরে। হাঁটতে গেলে মাঝে মাঝে পড়ে যায়। পা দুটি চিকন। হাতেও তেমন শক্তি নেই।
পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আরমান এর জন্মের আগে তার মায়ের প্রচ- প্রসব ব্যথা ছিল। প্রায় দুদিন ব্যথার পর বাড়িতে ধাত্রীর হাতে আরমান এর জন্ম হয়। জন্মের সময় অন্যান্য বাচ্চাদের মতো শিশু আরমান কাঁদেনি। গ্রামের চিরায়ত নিয়ম অনুযায়ী অনেক চেষ্টা করে জন্মের প্রায় দু ঘন্টা পর আরমানকে কাঁদানো হয়েছিল।
দুই দিন পর্যন্ত আর কোনো সমস্যা হয়নি। সে সুস্থ, স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু অসুবিধা দেখা দেয় তিন দিন থেকে। বাচ্চাটি মায়ের দুধ খেতে চায়না। হঠাৎ করে সমস্ত শরীর লাল হয়ে যায়। ঘুমায়না, কাঁদেও না।
পরিবারের সকলে অস্থির হয়ে গ্রাম্য কবিরাজের দ্বারস্থ হয়। কবিরাজ ঝাড়-ফুঁক দিয়ে বলে বাচ্চার কামেলা (জন্ডিস) হয়েছে। ঝাড়তে হবে। প্রতিদিন সকালে কবিরাজী চিকিৎসা চলে। এভাবে সাত দিন ঝাড় দেয়ার পর বাচ্চাটি কিছুটা স্বাভাকি হয়। খেতে শুরু করে।এভাবেই সে বড় হতে লাগলো। তার বয়স যখন ছয় মাস হলো তখন শুরু হয় অন্য সমস্যা। সাধারণত ৫/৬ মাস বয়স থেকেই ছোট বাচ্চারা হাত দিয়ে খেলনা ধরতে শেখে। কিন্তু শিশু আরমান তা পারতোনা। মুখে শব্দ করা বা কেউ ডাকলে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখা এসব পারতো। এভাবে আরো কিছুদিন কাটলো।
কিন্তু যখন তার দেড় বছর বয়স তখনও সে হামাগুড়ি দিতে পারতোনা। শুধু শুয়ে থাকতো। কেউ ধরে তাকে বসিয়ে দিলেও বসে থাকতে পারতোনা। পরিবারের সদস্যরা আবার তাকে কবিরাজের কাছে নিয়ে গেলেন। তখন কবিরাজ বললেন বাসি মুখে গোবরের ছাই দিয়ে তার হাত পা মালিশ করে দিতে। এভাবেই তার চিকিৎসা চলতে থাকলো। যখন খাবারের প্রতি আবার অনীহা চলে আসে তখন তার পরিবার তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ডাক্তার অনেক পরীক্ষা করে বলে ভিটামিনের অভাব আর মাথার রগে সমস্যা। ‘বিকোজিন’ নামক একটি সিরাপ খেতে দেয় তিন মাস। তাতেও তেমন লাভ হয়না। ছেলেটি প্রায় দুই বছর বয়সে বসতে শিখে। এর পর হাঁটা। স্বাভাবিক খাবার সে খেতে পারে। কথা বলাও শিখে নেয়। বর্তমানে সে একজন শারিরীক প্রতিবন্ধি।
এখন তার বয়স ৯ বছর। সে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২য় শ্রেণিতে পড়ে। পড়া লেখা করতে পারে। তবে চুপ করে কোথাও বসে থাকতে পারেনা। সব সময় শরীর কাঁপে। যে কারণে হাঁটতে গেলে পড়ে যায়। বুদ্ধির ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা নেই। বরঞ্চ অন্যান্য শিশুদের চেয়ে তার বুদ্ধির প্রখরতা অনেক বেশি।
পরিবারের কেউ বুঝতে পারেনি যে ছেলেটি প্রতিবন্ধি। কারণ জন্মের সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত তার শারীরিক যে সমস্ত লক্ষণগুলো প্রকাশ পেয়েছে সবগুলোই প্রতিবন্ধিতার লক্ষণ। শুধুমাত্র অজ্ঞানতার জন্য একটি শিশুর জীবন হুমকির মুখে। কারণ সে স্বাভাবিক মানুষের মতো কথা বলা বা হাঁটাচলা করতে পারেনা। যে কারণে পাড়া প্রতিবেশি বা সমবয়সীরা তাকে ল্যাংড়া বা লুলা বলে ক্ষ্যাপায়। একটু দুষ্টুমি করলে পরিবারের সদস্যরা তাকে মারতেও দ্বিধাবোধ করেনা।
আরমান এর আরো দুটি ভাই আছে, তারা সুস্থ্য। ভাইদের মতো যদিও সে শারীরিকভাবে অতোটা স্বাভাবিক নয় তবুও তার শিশু বয়সের দুরন্তপনা আছে। সে তার ভাইদের সাথে ডোবায় মাছ ধরতে যায়। গাছে চড়ে পাখির বাচ্চা ধরে, ফড়িং যোগাড় করে পাখিকে খাওয়ায়। এমনকি সে পানিতে সাঁতার কাটতেও পারে।
আরমান এর পরিবারে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা আছে। তার বাবা কৃষিকাজের পাশাপাশি ব্যবসা করেন। কিন্তু টাকার অভাব না থাকলেও আরমানের প্রতিবন্ধিতা এখন ভালো করার কোনো সুযোগ নেই। অনেক দেরী হয়ে গেছে। বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক এর পক্ষ থেকে প্রতিবন্ধি ব্যক্তিদের নিয়ে যারা কাজ করেন তাঁদের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছিল। আলোচনায় জানা যায়, এই শিশুটির যদি আরো আগে অর্থাৎ ২/৩ বছর বয়সে চিকিৎসা শুরু করা যেতো তবে সে সুস্থ হতে পারতো। যেহেতু সে কথা বলা ও হাঁটা চলায় অভ্যস্ত তাই তার সুস্থ্য হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল।
শুধুমাত্র অজ্ঞানতা আর সচেতনতার অভাবে আমাদের আগামী প্রজন্ম দিন দিন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ছে। যাদের আছে অফুরন্ত প্রাণশক্তি আর উদ্যম তারা এই প্রতিবন্ধিতা নামক বিভিষীকায় নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। এই প্রয়োজন আছে বিভিন্ন সচেতনতামূলক আলোচনার। গর্ভকালীন, প্রসবকালীন ও প্রসব পরবর্তী সময়ে কি করণীয় সে বিষয়ে জনগোষ্ঠীকে আরো সচেতন হতে হবে। স্বাভাবিক শিশুদের সাথে তাদের বেশি করে মিশতে সুযোগ করে দিতে হবে। পরিবার ও সামাজিক পর্যায়ে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। তাদেরকে বাড়তি সময় দিয়ে, মনোযোগ দিয়ে তাদের সমস্যাগুলো বুঝে প্রতিকার করতে হবে। তাহলেই আমাদের সমাজের প্রতিবন্ধি ব্যক্তিরা সমাজের বোঝা না হয়ে সম্পদে পরিণত হবে।