প্রতিবন্ধি ব্যক্তিরা অসহায় নয়
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
যদিও প্রতিবন্ধিতা কোনো রোগ নয়, তবুও এটি আমাদের সমাজের মানুষের মনে ব্যাধি হয়ে বসেছে। আমাদের দেশ এগিয়ে গেলেও সমাজ এগুচ্ছেনা। একজন প্রতিবন্ধি ব্যক্তি যতটা না শারীরিকভাবে তার শরীরে ক্ষত বহন করে, তার চেয়ে অধিক ক্ষত দেখা যায় সমাজের চোখে। তাকে দেখলেই আড় চোখে তাকায়, আ হা, উ হু করে। অথচ তার সমস্যায় সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনা।
একজন শিশু জন্মের পর তাকে ঘিরে পরিবারে সাথে সাথে সমাজের মানুষের আগ্রহের কোনো শেষ থাকে না। কিন্তু জন্মের পর যখন তার শারীরিক কোনো সমস্যা চোখে পড়ে, তখনই সবার উৎসাহে ভাটা পড়ে। কিন্তু সেই শিশুটির প্রাকৃতিক নিয়মে বেড়ে উঠা তো থেমে থাকে না। আর সকলের মতো সে স্বাভাবিকভাবেই বাঁচতে চায়। প্রকিবন্ধিতার সাথে যুদ্ধ করে বাঁচতে হয় তাকে।
লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের গদাইকান্দি গ্রামের ছোট্ট শিশু বর্ষা মনি। জন্মের সময়ই সে শারীরিকভাবে ‘খুঁত’ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তার বাম হাতের কনুইয়ের পরের অংশটি ছিল না। তবে শরীরের অন্যান্য অংশ স্বাভাবিক ছিল। এরকম শিশু জন্মের পরেই তার পরিবারের সকলের মনে কষ্ট নেমে আসে। সবচে’ কষ্ট পায় তার মা। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। এটি আল্লাহর দান বলে মেনে নেয়। মনে করে কোনো পাপের ফলে বোধহয় এমন সন্তান তিনি জন্ম দিয়েছেন।
একদিকে ‘খুতা’ সন্তান, অন্যদিকে মেয়ে, তাই শ্বশুর বাড়িতে তাঁর ঠাঁই হলো না। তাই মেয়ে আর স্বামীকে নিয়ে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নিতে হলো বর্ষার মা’কে। বর্ষার যখন ছয় মাস বয়স তখন তার মা আর বাবা ঢাকা চলে যায়। সেখানে গিয়ে গার্মেন্টস এ কাজ নেয়। বর্ষা নানীর কাছেই বড় হতে থাকে। তার মা বাবা মাঝে মধ্যে এসে তাকে দেখে যায়।
বর্ষা এখন গদাইকান্দি সরকারী প্রাথমিত বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছে। পড়ালেখাতেও ভালো। একটি হাতের অর্ধেক অংশ নেই বলে সে কোনো কাজে থেমে থাকেনা। এক হাত ব্যবহার করেই সে সকল কাজ করতে পারে। মাঠে গরু চড়াতে যায়। মাছ, তরকারী কাটে। তবে যে কাজে দুটি হাতের প্রয়োজন হয় সে সকল কাজে বাম হাতের কাটা অংশটিই সে তার মতো করে ব্যবহার করে।
নিজের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজও সে এখন নিজেই করতে পারে। আগে অবশ্য নানীর সাহায্য নিয়ে করতে হতো। কিন্তু নানী ভেবে দেখলেন যে, মেয়ে বড় হচ্ছে। ভয় পেয়ে তাকে আগলে রাখলে ভবিষ্যতে সে আরো অসহায় হয়ে পড়বে। তাছাড়া তিনি তো সারা জীবন বেঁচে থাকবেন না। সব সময় বর্ষার সাথেও থাকতে পারবেন না। নিজের কাজতো নিজেকেই করতে হবে। মেয়ে হয়ে জন্মেছে, যদি ভাগ্যে থাকে তবে একদিন বিয়েও হবে। তখন তার সংসারের কাজ কে করে দিবে ? তাই তিনি বর্ষার সকল কাজে উৎসাহ দিয়ে, সাহায্য করে কাজে স্বাবলম্বী করে তুলছেন।
বর্ষা স্কুলে যাওয়ার সময় নিজের চুল আঁচড়ে বেঁধে নিতে পারে। স্কুল ড্রেস পড়তে পারে। সমবয়সীদের সাথে খেলার সময় রান্না করতে গিয়ে রান্নার তরকারীও সে নিজেই কাটে। অন্যদের দেয়না। পড়া লেখার পাশাপাশি নানীর সংসারের কাজ যেমন মাছ কাটা, তরকারী কাটা সব কাজ সে করে দেয়। উঠান ঝাড়ু দেয় খূব সুন্দর করে। প্রতিবেশিরাও বললেন স্বাভাবিক, সুস্থ মানুষের চাইতেও বর্ষা সুন্দর করে কাজ করে।
শারীরিক প্রতিবন্ধি বলে সে থেমে থাকেনি। পরিবারের সহযোগিতায় সে স্বাভাবিক মানুষের মতো বেড়ে উঠছে। তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সহায়তায় উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে সে প্রতিবন্ধি ভাতা পাচ্ছে। গত বছরই তার নামে একটি কার্ড করে দেয় সেই প্রতিষ্ঠানটি। বাৎসরিক ছয় হাজার টাকা সে পেয়েছে।
আমাদের দেশে প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে অজ্ঞানতা এখন দূর হতে চলেছে। একীভূত শিক্ষা ব্যবস্থাও চালু হচ্ছে ধীরে ধীরে। সমাজের যারা আগে বর্ষার প্রতি ভিন্ন দৃষ্টিতে তাকাতো, তারাই এখন বর্ষার প্রশংসা করে। বর্ষা ছোট হয়েও শিখিয়েছে কিভাবে নিজে বদলে সমাজের দৃষ্টি ভঙ্গি বদলাতে হয়।