নারীকে মাথা তুলে দাঁড়াতে হবেই
মাহমুদা রিদিয়া রশ্মি:
’থিংক ইক্যুয়াল, বিল্ড স্মার্ট, ইনোভেট ফর চেঞ্জ’। বাংলায় দাঁড়ায় ‘সমতার লক্ষ্যে সৃষ্টিশীলতা: পরিবর্তনের ধারায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াই’। খুবই সময়ানুগ ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিপাদ্য বিষয়টি জাতিসংঘ নির্ধারন করেছে, যেখানে সৃষ্টিশীল হওয়ার ওপর জোর দেয়া হয়েছে, নারীর বিরুদ্ধে সকল প্রকার বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে সমতা অর্জনের জন্য। প্রতিপাদ্য বিষয়টিতে ’বৈষম্য’ শব্দটির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে কারণ পৃথিবীতে ভেদাভেদ ও বৈষম্য চর্চা দিব্যি চলছে। ভেদাভেদ ভাবনায় ভিন্ন শারিরীক গঠন বৈশিষ্ট্যের দুটি মানুষের মাঝে বিভেদ ও দ্বন্দ তৈরী করছে। কিন্তু বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয় যে, বৈষম্য দূরীকরণে পুরুষকে আদর্শ ভেবে তাদের সমান হতে, সমাজে স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই নারীদের বিশেষ দিবস সমূহ পালন করা হয়। তাহলে বলতেই হয়- বিশেষ দিবসগুলো তখনই পালন করা হয়, কোন নিগৃহীত বা সুবিধাবঞ্চিতের অধিকার চরম মাত্রায় লঙ্ঘিত হলে। বিশেষ দিবস পালনে পুরুষ সমাজকে প্রাধান্য দেবার সাথে সাথে নারীদের ছোট করা হচ্ছে। এবং কৌশলে নারীদের সুবিধাবঞ্চিত সংখ্যালঘুর ক্যাটাগরিতে ফেলা হচ্ছে। একটু বাঁকাভাবে বললে, গুণগত বিবেচনায় পুরুষরা অনেক কিছুতেই নারীদের চেয়ে দুর্বল বা খাটো কিন্তু অতিরঞ্জিতভাবে প্রদর্শন করে আমরা তাদের হিরো বনে পাঠাচ্ছি। ফলে তাদের ডমিনেটিক সাইকোলজি তৈরী হচ্ছে এবং তাতে ভিকটিম হচ্ছে নারীরা। নারী দিবস পালন নিঃসন্দেহে মহৎ উদ্যোগ এবং প্রতি বছর উৎসবমুখর পরিবেশে তা পালন করা হচ্ছে। নারী দিবস পালনকে অনেক গর্বের কাজ ধরা হলেও, এটি উদযাপনে নারীদের মূলত ডমিস্টিক চোখে অবলোকন করছে পুরুষ সমাজ। যেমন এক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, নারী দিবসকে উপলক্ষ্য করে বিপনী প্রতিষ্ঠানসমূহ গৃহস্থালি পণ্যের উপর বিশেষ মূল্য ছাড় দিয়েছে-নারীর সৌন্দর্য্য চর্চায় প্রসাধনী সামগ্রীতে ২০% বা গুড়া সাবানের সাথে হারপিক ফ্রি। নারী দিবস উপলক্ষ্যে এসব গৃহস্থালি পণ্যের মূল্যছাড়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীকে কোন জায়গা দেখতে চায় তা বুঝবার বাকী আছে কি! এবং কীর্তিমতী নারীর এওয়ার্ডটিও কিন্তু এই দিবসকে উপলক্ষ্য করেই দেওয়া হচ্ছে। নারীর কীর্তি স্বীকৃতি এই দিনটিতে দেওয়া মানেই ভদ্র ভাষায় বুঝিয়ে দেওয়া,’নারী তুমি দ্বিতীয় শ্রেণীর প্রাণী। সম্মানজনক কোন পেশা তোমার জন্য বরাদ্দ নেই, গৃহস্থালি কাজই তোমার জন্য যথেষ্ট’। জানা দরকার- প্রতি বছর নারী দিবসে যে প্রতিপাদ্য বিষযগুলো নির্ধারন করা হয়ে থাকে তার কতভাগ কার্যসম্পাদনে পুরুষ সমাজ উদ্যোগ নিয়েছে? শুধুমাত্র নারীকে ব্র্যান্ডিং করে বিভিন্ন শ্রেনীর পেশাজীবিরা অর্থ তহবিল নিলেও, বৈশি^ক রাজনীতিতে নারীর জন্য নেয়া উদ্যোগগুলো তারা নথিপত্রেই জমা করে রাখে। নিজের মানবিক দায়িত্ববোধ নয় বরং পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে বা বাধ্য হয়েই অধিকাংশ পুরুষ সমতার স্লোগান দিলেও, কখনই ঘরে বা কর্মক্ষেত্রে সমতা নিশ্চিতের উদ্যোগ নেননি তারা।
ঘাট পাড়াপাড়ের জীবনে প্রত্যেক নারীকে গুনতে হয় বৈষম্য। বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রিধারী একজন নারীর চাকরিতে প্রবেশাধিকারের অনুমতি মেলেনি শুধুমাত্র উঁচু নাকওয়ালা ব্যানার্জী/ খান বাড়ির বউ হবার জন্য। কারণ তাতে এ বাড়ির ইজ্জত ধূলোয় মিশে যাবে। প্রশ্ন হলো: পুত্রবধূ কি জন্মের পর থেকে শ্বশুড় বাড়ির খেয়ে,পড়ে বড় হয়েছে যে দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে এ বাড়ির সম্মান রক্ষা করবে! এটা আমাদের সামাজিক মানসিকতা। বিয়ের পর প্রত্যেক নারীর জন্যই চাকুরী বা পড়াশুনা করতে না দেওয়ার নীল নকশা তৈরী হয়ে থাকে। কেউ মুখ বুঝে বৈষম্য মেনে নেয় আবার কেউবা প্রতিবাদ করে। একজন নারীর অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হবার জন্য অবশ্যই ঘর থেকে বৈষম্য দূর করতে হবে। নারীরা সর্বক্ষেত্রে সমতার অধিকারে বৈষম্যের শিকার হবেনা বা প্রযুক্তি নির্ভর কর্মক্ষেত্রে দক্ষ কর্মীর ভূমিকায় থাকবে তখনই যখন সমাজের মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটবে।
সমতার অধিকার আদায়ের চর্চা যদি গোড়া থেকেই হয় (ঘরে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান) তবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে নারীরা কর্মক্ষেত্রে সমতা নিশ্চিতের জন্য লড়াই করতে পারবে সেটা হোক শুধুমাত্র সৃষ্টিশীল চিন্তা-কর্মের দ্বারা বা অন্য কোন উপায়ে। প্রযুক্তির বিশে^ যেখানে উন্নত দেশের নারীরা বিশ^ায়নের সমান তালে হাটছে সেখানে বাংলাদেশের নারীদের ঘর থেকে বের করবার জন্য, কর্মক্ষেত্রে সমান সুযোগের জন্য যুদ্ধ করতে হচ্ছে। এটা অনস্বীকার্য যে, পৃথিবীব্যাপী জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতি সাধনে উৎপাদন পদ্ধতি বদলে যাচ্ছে, শারীরিক শ্রমনির্ভর ব্যবস্থার বদলে এখন যন্ত্রনির্ভরতা বাড়ছে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারীরা বিশ^ায়নের সমান তালে হাটার জন্য উঁচু পদগুলোতে সুযোগও কম পাচ্ছে পাশাপাশি তাদের ন্যায্য পারিশ্রমিকও নিশ্চিত হচ্ছে না। বর্তমানে অদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা কমে- বাড়ছে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা। এই পরিপ্রেক্ষিতে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যেতে হলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীকে প্রযুক্তি দক্ষতায় অন্তর্ভূক্ত বা তাদের দক্ষতাকে নতুন চাহিদার উপযোগী করতে হবে। নারীদের সমতার অধিকার আদায় নিয়ে এতো কথা বলারপূর্বে জাতীয়-আন্তর্জাতিক আইনি ও নীতিগত ভিত্তিতে নারীদের যেকান সময়, সব জায়গায় অংশগ্রহণের অধিকার নিশ্চিত প্রয়োজন। নারীকে অসহায় না ভেবে সকল ক্ষেত্রে মানুষ হিসেবে গণ্য এবং তাদের অর্থনৈতিক কাজে উৎসাহ দানের জন্য সকল সহযোগিতার ব্যবস্থা করতে হবে এবং তাতে যেন নারীকে ভোগের পণ্য হিসেবে দেখা না হয়। এমনকি পরিবারেও নারীর সিদ্ধান্ত নেবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য অতীব জরুরী সমাজের পুরুষ মানসিকতার পরিবর্তন, যেন তারা নারীদের ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে।
লেখক পরিচিতি: নারী অধিকারকর্মী
এম.ফিল শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়