ঘূর্ণিঝড় ফণি: স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে আমার ভূমিকা
সাতক্ষীরার শ্যামনগর থেকে স.ম ওসমান গনি সোহাগ
কয়েকদিন ধরেই রেডিও, পেপার-পত্রিকা, টিভি মিডিয়াতে একটি ঘূর্ণিঝড়ের নাম বারবার শোনা যাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়ের নামটা ফণি। ঝড়ের নামটা অপরিচিত হলেও এই ঝড় সম্পর্কে আমরা অনেক আগে থেকেই অবগত। কারণ উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ জন্মের পর থেকে কয়েকবার করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা ঘূর্ণিঝড়, প্লাবণ, সাইক্লোন, সিডর, আইলা বিভিন্ন ঝড়ের কবলে পড়েছি আমরা। এজন্য ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে কিছুটা হলেও আমরা জানি।
তাছাড়া সরকারি, বেসরকারি মাধ্যম দিয়ে আমরা সিগনালের খবর পাচ্ছি। দিনটি বৃহস্পতিবার। সকাল হতে না হতেই বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকেরা বড় বড় ক্যামেরা আর বুম নিয়ে আমাদের এলাকায় হাজির। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে বারবার মাইকিং করে সিগনাল দিচ্ছে। এদিকে শ্যামনগর উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উপজেলার সকল স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবকদের মোবাইল নম্বরসহ তালিকা জমা নিচ্ছে। যেকোন প্রয়োজনে আমরা যেন প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে পারি।
আমরা কোস্টাল এডুকেশন ডাইভার্সিটি ইমপ্রুভমেন্ট অর্গানাইজেশন (সিডিও) এর স্বেচ্ছাসেবক। ঘূর্ণিঝড়ে এলাকাবাসীদের সচেতনতা ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক সেবামূলক কাজ আমরা করে থাকি। বৃহস্পতিবার সারাদিনটা গেলো ব্যানারসহ সমগ্র উপজেলা প্রচার ও সচেতনতায়। বৃহস্পতিবার দিনটা শেষ হয়ে যত সময় অতিবাহিত হচ্ছে আমাদেরও ভয়ও বাড়তে শুরু করছে। যেকোনভাবে সেদিনকার রাতটা পার করলাম।
শুক্রবার সকালে ঘূর্ণিঝড় ফণির তীব্রতা আরও বাড়তে গেলো। টিভি, রেডিও এবং চারিদিকে মাইকিং হচ্ছে আমাদের এই উপকূলীয় সাতক্ষীরা জেলা সহ আরও কয়েকটি জেলায় রাতে আঘাত হানতে পারে। শুক্রবার পবিত্র জুম্মার আজান হওয়ার সাথে সাথে আকাশে মেঘের ঘনঘটা। সেই সাথে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। আকাশটা যেন অঝোরে কাঁদছে। সেই সাথে প্রবল ঘূর্ণি বাতাসে গাছপালাগুলো যেন হাওয়ার তালে তালে দুলছে। সরকারি দপ্তর থেকে সকল ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে শুকনা খাবার পৌঁছে দেওয়া শুরু হয়েছে। সেই সাথে আমরা সিডিওর পক্ষ থেকেও জুম্মায় দোয়া অনুষ্ঠান করে যারা ইতিমধ্যে সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নিয়েছে তাদের জন্য শুকনা খাবার সরবরাহ করা শুরু করেছি।
দুপুরে খেয়ে না খেয়ে শুকনা খাবার নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সাইক্লোন শেল্টারে ছুটে চলা। সেখানে কি করুণ হৃদয় বিদারক দৃশ্য। গৃহপালিত পশু ও মানুষ একসাথে বসবাস। মায়েরা তাদের বাচ্চাদের মুখে তুলে খাওয়াচ্ছে। এটাই হয়তো শেষ অন্ন তুলে দেওয়াও হতে পারে। তবুও একটুখানি মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিতে আবার অনেকের আপ্রাণ চেষ্টা। বিকাল হতেই সাইক্লোন শেল্টার গুলোতে তিল ধারনের ঠাঁই নেই। সেখানে যেয়ে আমরা সিডিওর স্বেচ্ছাসেবকরা আশ্রিত সকলের মাঝে শুকনা খাবার বিতরণ করি। সন্ধ্যা থেকেই উপজেলা প্রশাসন এবং স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিরা আমাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে চলেছেন। সন্ধ্যা থেকেই আমরা দলবেঁধে বিভিন্ন এলাকায় এলাকায় ঘুরে মানুষকে ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে অবহিত করে চলেছি।
শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের নীলডুমুর খোলপেটুয়া নদীটি উত্তাল ঢেউ তুলে ফণির ফনা তুলতে শুরু করেছে। রাত্রে নাকি আরও কয়েক ফুট পানি বৃদ্ধি হবে৷ এলাকার মানুষের ভয়টা এখানেই। যদি পানি বৃদ্ধি হয় তাহলে পূরাতন ডিজাইনের ওয়াপদাগুলো ভেঙ্গে সমস্ত জেলা প্লাবিত হওয়ার আশংকা রয়েছে। সন্ধ্যার পরেই জনপ্রতিনিধিরা কয়েক দফায় সাইক্লোন শেল্টার, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, রিসোর্ট, ঘূর্ণিঝড় সহনীয় দালানে আশ্রিত মানুষদের খোঁজখবর নিচ্ছেন। সেই সাথে আমরা বয়স্ক ও শিশুদেরকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যেতে সহায়তা করছি।
এভাবেই চললো রাত ১০টা পর্যন্ত। সাড়ে ১০ টার দিকে নদীতে জোয়ার আসা শুরু করেছে। আমরা নদীর চরে একটা দাগাকাটা কাঠি পুঁতে দিলাম। নদীর জোয়ার পরিমাপ করার জন্য। বৃষ্টি ঝরছে নিরবধি। সেই সাথে দমকা ঝড়ো হাওয়া। ইতিমধ্যে অনেকের ঘরের চাল উড়তে শুরু করেছে। আমরা সবাই মিলে হাতে হাতে ধরে রাস্তা থেকে টিনের চালগুলো সরিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় রাখলাম। প্রায় দুই থেকে আড়াই ঘন্টা জোয়ার উঠার পর নদী তখন থমথমে। উঁচু ওয়াপদা থেকে মাত্র দেড় ফুট নিচে পানির স্তর। আমরা জানটা হাতের মুঠোয় নিয়ে সারারাত নদীর পাড়ে রাস্তার ধারে কাটালাম। ভোর ৪ টার দিকে খবর পেলাম শনিবার ৭-৮ টার দিকে ফণি সাতক্ষীরার উপর দিয়ে অতিক্রম করবে। এতক্ষণে ভারতে আঘাত হানার পর ফণির গতি কিছুটা হ্রাস পেয়েছে।
ঠিক ৭-৮ টার দিকে ঘন্টায় প্রায় ৮০-৯০ কিঃমিঃ বেগে দমকা ঝড়ো হাওয়া বয়ে গেলো আমাদের উপকূলবর্তী জেলার উপর দিয়ে। জানের কোন ক্ষতি না হলেও মালামালের ক্ষতি করে আরও কয়েক ঘন্টা স্থায়িত্ব নিয়ে ফণি আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিলো।