আলোকিত মা মালতী রানী
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমি
‘আমার যখন খেলার বয়স তখন আমি সংসার জীবনে পা রাখি। কোন রকমে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনার পরই এক যৌথ পরিবারের বউ হই। স্বামী পৌরসভা অফিসের একজন ঝাড়–দার। সংসার কিছু বুঝে ওঠতে ওঠতেই সন্তানের মা হই। দিন দিন সংসার বড় হতে থাকে এবং এক পর্যায়ে আমার পৃথক সংসার হয়। পৃথক হওয়ার পর আমার মাথা গোজার কোন ঠাই ছিল না। স্বামী এক হাজার টাকা মাইনা পায়, এ টাকায় খেয়ে না অনেক কষ্ট সংসার চালাতে হয়। আমি তখন কিশোরী বধু। হাসঁ-মুরগি, গরু ছাগল পালন করা মত কোন জায়গায় নেই। স্বামী অন্যের বাসায় কাজ করতে দেয় না আমরা অন্য জাতি বলে। অভাবের সংসারে কোন রকমে বেঁচে আছি।” উপরোক্ত কথাগুলো বলছিলেন নেত্রকোনা জেলার পূর্ব চকপাড়া গ্রামের সমাজে দলিত শ্রেণীর জাত বলে পরিচিত হরিজন পাড়ার মালতী রানী (৩৭)। দুই সন্তানের জননী মালতী রানীদের বাড়ি ছিল সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা উপজেলায়। অভাবের তাড়নায় গ্রাম থেকে নেত্রকোনা শহরে আসা। শহরে বাসা ভাড়া করে থাকার মত টাকা পয়সা ছিল না। টাকা পয়সা না থাকায় কোন রকমে মাথা গোজার জন্য ঠাইঁ হয় শহরের বস্তিতে।
স্বামীর উর্পাজনে পরিবারের সদস্যদের ক্ষুধা মেটানো দায় ছিল। তাই বেঁচে থাকার জন্য নিজেই অন্যের বাসা বাড়িতে ঝাড়–দারের কাজ নেয়। দু’জনের রোজগারে এখন ভালভাবেই তার দিন চলে যায়। নিজের কষ্টের পাশাপাশি অন্যের কষ্টও তাকে ভাবিয়ে তুলতো। নিজেকে তিনি শুধুমাত্র নিজের সংসারেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। অন্যের পরিবারের সমস্যা দূর করতে নিজ থেকে অর্থ সহায়তা কিংবা পরার্মশ দিয়ে সহায়তা প্রদানের কাজ তিনি ২০ বছর আগে সংসারে কিছুটা স্বচ্ছলতা আসার পর থেকেই শুরু করেন। বস্তিবাসীদের মারামারি, হানাহানি, ক্ষুধা, অভাব-অনটন, অপরিচ্ছন্ন মানবেতর জীবনযাপন তার ভালো লাগতো না। ওদের জন্য কিছু করার খুব ইচ্ছে।
মালতী রানী ছোট বেলায় মা-বাবাকে হারান। জীবনের সাথে সংগ্রাম করে তিনি বড় হন। তার স্বপ্ন ছিল মেয়ে পায়েল বাসফোরকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মত মানুষ করে গড়ে তোলা। মেয়ে পায়ের বাসফোর খুব সাহসী একজন মেয়ে। পায়েলের বাবার মেয়েকে নিয়ে তেমন কোন স্বপ্ন ছিল না। স্কুলে পাঠানোতে পায়েলের সামনেই বাবা প্রায়ই মাকে খুব মারধর করত। তবুও মালতী রানী খেয়ে ও না খেয়ে কষ্ট করে মেয়ে পায়েলকে বিনা পানি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। মেয়ে পায়েল বিনা পানি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পিএসসি পরীক্ষায় জিপিএ- ৪.৫০ পয়েন্ট পেয়ে উত্তীর্ণ হলে নেত্রকোনা আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ভর্তি করেন।
দলিত শ্রেণীর বলে প্রথমদিকে পায়েলের সাথে অন্য শিক্ষার্থীরা ভালো করে কথা বলত না এবং মিশত না। স্কুলে তার তেমন কোন বন্ধু ছিল না, এমন অবস্থায় পায়েলের পাশে দাঁড়ান স্কুলের একজন শিক্ষিকা তমা রায়। শিক্ষিকা তমা রায় অন্য শিক্ষার্থীদের এই বলে বোঝাতেন যে, সবাই মানুষ, কিভাবে অন্যদের সাথে কথা বলতে হয়, মিশতে হয় এবং মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার বিষয়ে তিনি পায়েলকে বোঝাতেন। শিক্ষিকা তমা রায় পায়েলের স্কুল জীবনের সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখেন। নেত্রকোনা আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পায়েল জিপিএ-৪.০০ পেয়ে জেএসসি এবং ২০১৯ সালে জিপিএ-৩.৬১ পেয়ে এসএসসি পাশ করেছে।
মালতী রানী যত কষ্ট হোক তিনি হাল ছাড়ার পাত্র নন। পুরো শরীরে স্বামীর নির্যাতনের (আঘাতের) চিহ্ন নিয়ে মেয়েকে লেখাপড়া করাচ্ছেন। পায়েল এখন সরকারি ডিগ্রী কলেজের ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী। মালতী রানীর স্বপ্ন মেয়ে পড়াশুনা শেষ করে একজন দক্ষ স্কুল শিক্ষক হবে। হরিজন পাড়া থেকে পায়েলসহ দু’জন দলিত শ্রেণীর মেয়ে প্রথমবার এসএসসি পাশ করেছে। এজন্য যিনি সবচেয়ে বেশি অবদান রাখেন তিনি হলেন মালতী রানী। তিনি নিজের মেয়েসহ দলিত শ্রেণীর অন্য বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানোর জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে থাকেন সব সময়। যেসব বাচচারা স্কুলে যায় না, তিনি তাদের অভিভাবকদের সাথে যোগাযোগ করে বুঝিয়ে স্কুলে পাঠাতে উৎসাহ দিয়ে থাকেন। নিজের ঘরে খাবার না থাকলেও অন্যদের খোঁজ খবর নেওয়া তার নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘুম থেকে ওঠে সাংসারের কাজ কোন রকমে শেষ করে বস্তির প্রত্যেক বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ না নিলে তাঁর ভালো লাগে না। নিজের পরিবারের মতো বস্তিবাসীর ভালো মন্দ দেখা তার দায়িত্ব হয়ে পড়ে।
বস্তিবাসীর সুযোগ-সুবিধা আদায় ও বস্তির পরিবেশ উন্নয়ন, বস্তি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা পরিবর্তনে জন্য চেষ্টা করছেন, যদিও এখন পর্যন্ত শিক্ষা ক্ষেত্রে সামান্য পরিবর্তন ছাড়া তেমন কোন পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হননি। এসম্পর্কে মালতী রানী বলেন, ‘এখনও নিজ সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠী ও অপরাপর জনগোষ্ঠীর মানসিকতার তেমন পরিবর্তন হয়নি, শিক্ষায় আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে, বসবাসের অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, খাবারের পানির সমস্যা, স্বাস্থ্যগত বিভিন্ন সমস্যায় আমরা জর্জরিত।’ তাই বস্তিতে একটি শিশুদের পড়ানোর জন্য স্কুল তৈরিতে বস্তির সকলকে সংগঠিত করে সংগঠন গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছেন। সংগঠনের সকলকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট সরকারি অফিসে যোগাযোগ করে বস্তির মেয়েদের হাতের কাজ শিখা ও সরকারি সুযোগ সুবিধাব পাইয়ে দেয়া তার স্বপ্ন।
দলিত শ্রেণী সমাজে সকল ক্ষেত্রে বঞ্চিত। মৌলিক চাহিদা থেকে শুরু করে সমাজের সকল স্তরে তারা বঞ্চিত। তাদেরকে সবসময় ঘৃণার চোখে দেখা হয়। অথচ এ সম্প্রদায় সমাজের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষভাবে শহর সমাজে আমরা যারা উঁচু জাতি বা উন্নত শ্রেণীর বলে নিজেদের দাবি করি এবং শহরে ব্যবসা বাণিজ্য করে এবং সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে আরাম আয়েসে জীবনযাপন করছি, তাদের জন্য দলিত সম্প্রদায়ের প্রয়োজনয়ীতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শহরের রাস্তা-ঘাট, ড্রেন, পয়োঃনিস্কাশন ব্যবস্থা পরিষ্কার পরিছন্ন করা এবং শহরবাসীদের ফেলে দেয়া পঁচা ও ময়লা আবর্জনা পরিস্কার করার দায়িত্ব এই দলিত জনগোষ্ঠীই পালন করে থাকে। তাদের তেমন কোন চাহিদাও নেই, শুধুমাত্র স্থায়ীভাবে থাকার জন্য চাই সামান্য বসতভিটা। তারা নিজেদের মতই থাকতে অভ্যস্ত। তারাও অন্যান্য জাতির ন্যায় এদেশেরই নাগরিক, তাদেরও ভালোভাবে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। শহরকে পরিস্কার পরিছন্ন রেখে শহরের উন্নয়ন তথা দেশের উন্নয়নে তাদের অবদানও কোন ক্ষেত্রে ফেলনা নয়। একদিন তারা তাদের কাজ বন্ধ রাখলে শহর জীবন অচল হয়ে পড়ে। তাই শুধু এ জাতি ও বস্তিবাসীদের উন্নয়ন বঞ্চিত করে অন্যান্য জাতির জনগোষ্ঠী ও শহরের উন্নয়ন করা হলে তা কোনভাবেই গণতান্ত্রিক হবে না। হবে না দেশের সকলের জন্য মানবাধিকার সুরক্ষিত। তাই জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী ও পেশা ভুলে দলিত শ্রেণীর জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে সকল সরকারি/বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে এগিয়ে আসতে হবে, সহায়তা ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে মালতী রানীর মত উদ্যোগী নারীদের উদ্যোগ বাস্তবায়নে। পাশে দাঁড়াতে হবে পায়েলের মত দলিত শ্রেণীর ছেলেমেয়েদের শিক্ষাসহ সকল ক্ষেত্রে উন্নয়নে, তবেই সফল হবে সরকারের মিশন ২০৪১। বাস্তবায়িত হবে স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের লক্ষ্য।