কাঠের নকশার কারিগর

নেত্রকনো থেকে হেপী রায়
নেত্রকোনা থেকে যুগ যুগ ধরে মানব সভ্যতার বিকাশের পর থেকে শৌখিন মানুষদের ঘরে শোভা পাচ্ছে কাঠের তৈরি আসবাবপত্র। এই সকল সামগ্রী যারা তৈরি করেন তাঁদের বলা হয়, কাঠ মিস্ত্রি বা সূঁতার। আমাদের সমাজে এদের স্থান খুব বেশি উঁচুতে নয়। তবুও এরা অনেক দামী মানুষ। কারণ এঁদের তৈরি করা আসবাবপত্র ব্যবহার করেই আমরা আমাদের প্রতিপত্তি জাহির করি। যার ঘরে যত বেশি নকশা করা কাঠের আসবাব থাকে সে তত বেশি ধনী ব্যক্তি বলে চিহ্নিত হয়।


লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের লক্ষ্মীগঞ্জ গ্রামের মো. খোকন মিয়া, যিনি পেশায় একজন কাঠ মিস্ত্রি। আগে এই পেশাটি অবশ্য শুধুমাত্র হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কারণ বংশ পরম্পরায় ‘সূঁতার’ উপাধিটি তাঁরাই ধরে রেখেছিলেন। কিন্তু কালের বিবর্তনে এই পেশাটি এখন মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যেও ছড়িয়ে গেছে। একদিকে কাজের পরিসর কম থাকায় অনেকেই বিভিন্ন পেশা বেছে নিয়েছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এমনও হয়েছে যারা কাঠমিস্ত্রিদের সহযোগি হিসেবে একসময় কাজ করতেন, তারাই পরে সুদক্ষ কারিগর তৈরি হয়ে গেছেন। এভাবেই কাঠমিস্ত্রিরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থেকে বেঁচে আছেন।


খোকন মিয়া কাঠের কারিগর হিসেবে কাজ করছেন প্রায় ৪২ বছর ধরে। ছোট বেলায় পার্শ্ববর্তী গ্রামের একজন কাঠমিস্ত্রির সহযোগি হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। এভাবে ৬/৭বছর কাজ করার পর নিজেই লক্ষ্মীগঞ্জ বাজারে একটি দোকান দিলেন। সেই দোকানে বসেই কাঠ দিয়ে নানা রকম আসবাবপত্র তৈরি করতে শুরু করলেন। এখন তার দোকানে ৮ জন কর্মচারী আছেন।


বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে তিনি ভালো মানের কাঠ জাতীয় গাছ সংগ্রহ করেন। তারপর এগুলো চিড়ে রোদে শুকিয়ে নেন। কাঠ যত শুকানো হবে তত মজবুত হবে। এরপর এগুলো বিভিন্ন আকারে কেটে নিয়ে তৈরি করেন চাহিদা মতো সামগ্রী। করাত, হাতুড়, বাডাল, মাডাল, রাঁদা, ড্রিল মেশিন ইত্যাদি উপকরণ ব্যবহার করে শক্তপোক্ত কাঠকে সাজিয়ে তোলেন ব্যবহার উপযোগি আসবাব।


আকাশী কাঠ সবেচেয়ে ভালো। এই কাঠের তৈরী আসবাবপত্র টেকসই হয়। এছাড়া সেগুন, মেহগনি, কাঁঠাল ও রেইনট্রি গাছ কাঠের জন্য ভালো। ক্রেতাদের ফরমায়েশ অনুযায়ী বিভিন্ন নকশাও করে দেন। বর্তমানে কাঠের সামগ্রীর নকশার বই কিনতে পাওয়া যায়। তিনি নিজেও নকশা তৈরি করতে পারেন। বেশি নকশা করলে কাঠ বেশি লাগে আবার মজুরিও বেশি।


আশেপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে তাঁর কাছ থেকে খাট, আলনা, শোকেস, চেয়ার, আলমারি, টেবিল, ড্রেসিং টেবিল ইত্যাদি তৈরি করে নিয়ে যায়। আবার কলমাকান্দা, মদন, নেত্রকোণা, ময়মনসিংহ ইত্যাদি এলাকার ধনী পরিবারের বাড়ির জন্যও তিনি আসবাব তৈরি করে দেন। মানুষের সামর্থ্য অনুযায়ী নকশা করা কাঠের আসবাব তৈরি করে নেয়।
সবচেয়ে কম দামী কাঠ হলো রেইনট্রি গাছের কাঠ। এটির চাহিদাও কম। বেশি নকশা করে যে কোনো আসবাব তৈরিতে সময় লাগে ৫/৬দিন। বড় খাটে নকশা করে বিক্রি করলে ভালো দাম পাওয়া যায়। ৩৫-৫০ হাজার টাকায় এসব খাট বিক্রি হয়। তবে এত দাম দিয়ে এখন আর কেউ এগুলো তৈরি করতে চায়না। বর্তমানে কাঠের বিকল্প হিসেবে অনেক নিত্য নতুন, আকর্ষণীয় নকশার আসবাবপত্র বাজারে এসেছে। সূলভ মূল্যে পাওয়া যায় বলে অধিকাংশ মানুষ এসবই কিনছে।


আজ থেকে ১৫/২০বছর আগেও কাঠের সামগ্রীর চাহিদা ছিল অনেক বেশি। পূজা, ঈদ, বিয়ে ইত্যাদি আচার অনুষ্ঠানে মানুষ নতুন করে আসবাব তৈরি করতেন। আবার বিয়েতে উপহার হিসেবেও কাঠের আসবাব দেয়ার প্রচলন ছিল। কিন্তু বর্তমানে এটি অনেক কমে গেছে। সবাই শুধু সাজানো দোকানের দিকে যায়, কাঠমিস্ত্রির কাছে আসেনা।


তাই খোকন মিয়াদের মতো কাঠমিস্ত্রিদের কদর দিন দিন কমে যাচ্ছে। সব সময় কাজও এক রকম থাকেনা। বছরের প্রথম দিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যখন নতুন বেঞ্চ বানাতে হয় তখন কাজের চাপ একটু বেশি থাকে। আবার মদনপুরের মেলার জন্য কম দামেরও কিছু আসবাব তৈরি করেন। তখন ক্রেতা পাওয়া যায় বেশি। অন্যান্য জিনিসের পাশাপাশি জলচৌকি, পিড়ি, রুটি তৈরির উপকরণ, ডাল ঘুটনি ইত্যাদি বানিয়ে বিক্রি করেন।


এভাবেই কাজ করে না করে দিন যাচ্ছে খোকন মিয়ার। পরিবারে ৫জনের খাওয়া, ছেলে মেয়ের লেখাপড়ার খরচ, কর্মচারীদের বেতন সব কিছু যোগাড় করতে দিন রাত পরিশ্রম করতে হয় তাঁকে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় সহজ হয়েছে অনেক কিছুই কিন্তু কঠিন হয়ে গেছে খোকন মিয়াদের বেঁচে থাকা।

happy wheels 2

Comments