ধানের বিকল্প ফসল খুঁজে পেয়ে হাওরাঞ্চলের কৃষকরা খুশি
নেত্রকোনা থেকে শংকর ম্রং
আজ (১৬ মার্চ) নেত্রকোনা জেলার মদন উপজেলার গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নের সরকারহাটি গ্রামে তলার হাওর কৃষক সংগঠনের পরিচালনায় রবি মৌসুমে কৃষক নেতৃত্বে শস্য ফসলের জাত নির্বাচনের লক্ষ্যে বৈচিত্র্যময় শস্য ফসলের প্রায়োগিক গবেষণাকে কেন্দ্র করে আয়োজিত হয়েছে এক কৃষক মাঠ দিবস। বারসিক নেত্রকোনা’র প্রতিনিধি শংকর ¤্রং এর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন গোবিন্দশ্রী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শামসুল আলম। অনুষ্ঠানে দু’টি ইউনিয়নের কিশোর, কৃষক, শিক্ষক ও ব্যবসায়ীসহ ৪০ জন অংশগ্রহণ করেন।
সকাল ১১:০০ টায় বারসিক মদন কর্মএলাকার মাঠ সহায়ক (কৃষি) সুমন তালুকদার এবং তলার হাওর কৃষক সংগঠনের সভাপতি মো. আব্দুল হান্নান মিয়ার নেতৃত্বে প্রায় ৩০ জন কৃষক, শিক্ষক, ব্যবসায়ী ও সরকারী কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাগণ গবেষণাধীন শস্য ফসলের মাঠ সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। অংশগ্রহণকারী কৃষকরা ১৭টি শস্য ফসলের প্লট পরিদর্শন করে হাওর এলাকা উপযোগি হিসেবে (খরা সহনশীল, কম সময়ে হয়, উৎপাদন খরচ কম, ফলন বেশি, পোকার আক্রমণ কম, সেচ কম লাগে, বাজারমূল্য বেশি, জ্বালানি হয় ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে) ৬টি শস্য জাত নির্বাচন করতে সক্ষম হয়। কৃষকদের নির্বাচিত শস্য জাতগুলো হল-সরিষা, ভূট্টা, খেসারি, ছোলা, কালোজিরা ও তিসি।
মদন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নাজমূল হাসান প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেন, ‘বারসিক কৃষক সংগঠনের মাধ্যমে অনেকগুলো ফসলের (১৭টি) জাত আপনাদেরকে গবেষণার জন্য সংগ্রহ করে দিয়েছেন। যার মধ্যে বেশ কিছু জাত রয়েছে আপনারা এগুলো কখনো দেখেন নাই। এসব জাত বারসিক সংগ্রহ করে এনেছে বরেন্দ্র অঞ্চল ও চরাঞ্চল থেকে। এগুলোর অনেকটিই প্লটে ভালো ফলন দিয়েছে। যেগুলোর বীজ নিয়ে আগামীতে ধানের বিকল্প ফসল হিসেবে নিজেদের জমিতে চাষ করলে আপনারা অনেক লাভবান হবেন।’ তিনি অংশগ্রহণকারী হাওরাঞ্চলের কৃষকদের উদ্দেশ্যে অলসতা না করে চরাঞ্চলের কৃষকদের ন্যায় কর্মঠ হওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি আরো বলেন, ‘চরের কৃষকরা খুব ভোরে মাঠে যায় এবং ফসল সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করে সকাল ৮টা নাগাদ বাড়ি গিয়ে খাবার খেয়ে বিশ্রাম করে। তারা সবজি ও শস্য ফসল বিক্রি করে মাসে অনেক টাকা আয় করে, যা চাকরির চেয়ে অনেক বেশি। রবি মৌসুম সাধারণত অক্টোবর-নভেম্বর থেকে শুরু হয়। এসময় হাওরের পানি নেমে যায়, এসময় যেসব জমি ভেসে উঠে সেসব জমিতে সরিষা, ভূট্টা, খেসারী, মসুরী, মটর, কালোজিরা, গম ইত্যাদি শস্য চাষ করলে ফেব্রæয়ারি ও মার্চ মাসের আধাআধি সময়ে ফসল ঘরে তোলা যায়। এসময় কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটারও কোন সম্ভাবনা থাকেনা।’ তিনি সরিষা ক্ষেত্রে বিনা সরিষা-৯ জাতের ফলন ভালো হওয়ায় এ জাতটি হাওরাঞ্চলে চাষ করার পরামর্শ দেন। কৃষকদের নির্বাচিত শস্য ফসলের জাতগুলোর বীজ কোথায় পাওয়া যাবে কৃষকদের এ প্রশ্নে উত্তরে তিনি কৃষকদেরকে কৃষি অফিসে ও বারসিক অফিসে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন।
মাঠ দিবসের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী পাঁচটি গ্রামের (গোবিন্দশ্রী, কদমশ্রী, বোয়ালী, কুলিয়াটি ও মদন) কৃষকদের মধ্যে কৃষক সাকু মিয়া, শফিকুল ইসলাম, রকুনুদ্দিন, রুবেল মিয়া ও শাহজাহান গবেষণা প্লট পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা সহভাগিতা করেন। তারা গবেষণা প্লট পরিদর্শন করে ৫টি শস্য ফসলের জাত পরবর্তী রবি মৌসুমে ধানের বিকল্প ফসল হিসেবে নির্বাচন করেন। বিভিন্ন দুর্যোগে ও সমস্যা (আগাম বন্যা, শিলাবৃষ্টি, খরা, রোগ-বালাইয়ের আক্রমণ, ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, কৃষি শ্রমিকের উচ্চমূল্য ও শ্রমিক স্বল্পতা ইত্যাদি) মোকাবেলায় তারা নির্বাচিত শস্য জাতগুলো ধানের বিকল্প ফসল হিসেবে চাষ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তারা আগামী মৌসুমে মানসম্মত ভালো বীজের জন্য বারসিক ও কৃষি বিভাগের সহযোগিতা কামনা করেন। কৃষক সাকু মিয়া ভূট্টা ও সরিষা, কৃষক শফিকুল ইসলাম সরিষা ও খেসারী, কৃষক রুবেন সরিষা ও ছোলা, কৃষক রকুনুদ্দিন সরিষা ও কালোজিরা (মসলা) এবং অন্যান্য সকল কৃষক সরিষা ফসল নির্বাচন করেন।
অনুষ্ঠান শেষে সভাপতির বক্তব্যে প্রধান শিক্ষক শামসুল আলম উপস্থিত কৃষকদেরকে একক ফসল বোরো ধান চাষের ক্ষয়ক্ষতি এবং ধানের বিকল্প ফসল হিসেবে বৈচিত্র্যময় ফসল চাষের উপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা করেন। তিনি হাওরাঞ্চলের সম্ভাব্য দুর্যোগ মোকাবেলায় সকল কৃষকদেরকে শুধুমাত্র বোরো ধান চাষ না করে বৈচিত্র্যময় শস্য ফসল চাষ করে হাওরাঞ্চলের দুর্যোগ মোকাবেলায় এগিয়ে আসার আহবান জানান।
বারসিক’র সহযোগিতায় কৃষক নেতৃত্বে শস্য ফসলের জাত গবেষণার ফলে হাওরাঞ্চলের কৃষকরা ধানের বিকল্প হিসেবে ৫টি শস্য ফসলের জাত নির্বাচন করতে সক্ষম হয়েছে, যা দিয়ে তারা ধান ফসলের উপর সম্ভাব্য দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষম হবে বলে কৃষকরা আশা প্রকাশ করেছেন।
উল্লেখ্য, আলোচনার শুরুতে বারসিক নেত্রকোনা অঞ্চলের সমন্বয়কারী অহিদুর রহমান রবি মৌসুমে শস্য ফসলের জাত গবেষণার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘হাওরাঞ্চলের কৃষকরা একক ফসল তথা শুধুমাত্র বোরো ধানের উপর নির্ভরশীল। বোরো মৌসুমে তাঁরা ধার-দেনা করে ধান চাষ করেন, কিন্তু অধিকাংশ মৌসুমেই তারা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোন সময় আগান বন্যা, কোন সময়ে ব্লাস্ট রোগ বা কোল্ড ইঞ্জুরি আবার কোন সময় শিলাবৃষ্টিতে কৃষকরা ব্যাপক ক্ষতির সন্মূখীন হন। হাওরাঞ্চলের কৃষকদের এসব দুর্যোগ মোকাবেলায় কৃষকদেরকে ধানের বিকল্প ফসল চাষে উদ্বুদ্ধকরণে এই প্রায়োগিক গবেষণা তলার হাওর কৃষক সংগঠনের মাধ্যমে স্থাপন করা হয়েছে। যেসব ক্ষেতে ধান ছাড়া অন্য শস্য ফসল চাষ করা যায় সেসব জমিতে ধান না করে অন্য ফসল চাষ করলে ধান চাষ করে যে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে সে ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। ধান ফসলের উপর দূর্যোগ মোকাবেলার একমাত্র উপায় হাওর এলাকা উপযোগি বৈচিত্র্যময় পষ চাষ।’ তিনি দূর্যোগ মোকাবেলায় ধানের পাশাপাশি বিকল্প ফসল চাষ করার পরামর্শ দেন।