আন্তঃনির্ভরশীল সম্পর্কের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই
সিংগাইর মানিকগঞ্জ থেকে শাহীনুর রহমান
অদৃশ্য করোনা ভাইরাসে মহা সংকটময় সময় পার করছে পৃথিবী। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন নাম। এর মধ্যে আবার ঘুর্ণিঝর আমফানের মহাতান্ডব। প্রকৃতি যেন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সম্ভবত, প্রকৃতির প্রতি মানুষের বৈরি আচরণই এর জন্য দায়ী। প্রকৃতি ও পরিবেশের কোন একটি উপাদানের ঘাটতি হওয়ার কারণেই এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাই সকল প্রাণের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে প্রকৃতিকেই জীবণ ধারনের একমাত্র উপাদান হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।প্রকৃতির প্রতি সহিংস আচরণও বন্ধ করতে হবে।
প্রকৃতিকে গুরুত্ব দিয়েই করোনাকালীন সময়ে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য দিবস ২০২০ এর প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করছে ‘আমাদের সমাধান প্রকৃতির মাঝে’। নানা রকম আয়োজনে প্রতিবছর আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য দিবস পালিত হলেও এবার নেই কোন আনুষ্ঠানিকতা। তবুও এই দিবসটি সকলের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতিতে নানা প্রাণের সমাহার ও উপস্থিতিকে আমরা প্রাণবৈচিত্র্য বলে থাকি। তাছাড়া, জল স্থল পরিবেশ প্রতিবেশ ও এলাকার জীবন্ত প্রাণীও উদ্ভিদের উৎসগত বৈচিত্র্য, বিশ্বে দেখা অদেখা জানা অজানা দৃশ্যমান অদৃশ্যমান সকল প্রাণের বহুমাত্রিক বৈচিত্র্যতাই প্রাণবৈচিত্র্য।
বাংলাদেশ প্রাণবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ একটি দেশ । এ দেশের নানাপ্রান্তের গ্রামীণ জনপদে ছড়িয়ে থাকা প্রাণবৈচিত্র্যের মধ্য দিয়েই আমরা আমাদের বেঁচে থাকার উপকরণ পেয়ে থাকি অবিরত। আর এই প্রাণবৈচিত্র্য ও মানুষের মাঝে রয়েছে একটি পারষ্পারিক আন্তঃনির্ভশীল সম্পর্ক। এই বৈচিত্র্যময় ও আন্তঃনির্ভরশীল সম্পর্কের মধ্য দিয়েই মানুষ বেড়ে উঠে। প্রকৃতি ও কোটি কোটি প্রাণের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেই মানুষ তার জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। প্রকৃতিই মানুষের শিক্ষার মুল সুতিকাগার। প্রাণ, প্রকৃতিই যে কোন দুর্যোগে পৃথিবী ও পৃথিবীর মানুষকে রক্ষার জন্য রেখেছে সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ অবদান। আবার,প্রতিবেশ ও পরিবেশ পদ্ধতির সাথে প্রাণী, উদ্ভিদ ও অণুজীব নিবিরভাবে সম্পর্কিত।
কিন্তু আধুনিক উন্নয়নের নামে প্রাকৃতিক পরিবেশের গুরুত্ব বিবেচনায় না রেখে আমরা এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বেছে নিয়েছি যা কোনভাবেই দেশের প্রাণ ও প্রকৃতির ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে পারেনি। উপরন্ত আমরা করে যাচ্ছি প্রকৃতির প্রতি বিরুদ্ধ আচরণ ও নির্মম সহিংসতা। সহিংসতা পরিহার করে সময় এসেছে প্রকৃতি ও প্রাণবৈচিত্র্যনির্ভর জীবন পদ্ধতিকে অনুসরণ করার। মহামারি করোনা ও ঘূর্ণিঝড় আমফান তা দেখিয়ে দিয়েছে। প্রকৃতির কোটি কোটি প্রাণের মধ্যে মানুষ মাত্র একটি প্রাণ। কিন্তু প্রকৃতির কাছে আজ মানুষ কতই না অসহায়। অদৃশ্য করোনার কাছে হারতে বসেছে মানুষের বাহদুরি। সিডর, আইলা, নার্গিস, মহাসেন, ফনি, বুলবুল, আমফান থেকে মানুষকে বাঁচাতে বারবার বুক পেতে দিয়েছে সুন্দরবন। আবার আমরাই সুন্দরবনকে উজাড়ে করতে বিনা প্রয়োজনে গাছ কাটি, আনন্দের সাথে শিকার করছি অসহায় পাখি। কাজেই নিজেদের অস্তিত্ব ও স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের জন্য প্রাণবৈচিত্র্য ও প্রাণ, প্রকৃতি পরিবেশের আন্তঃনির্ভরশীল সম্পর্কের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া যেমন জরুরি তেমনি আন্তঃনির্ভরশীল সম্পর্কগুলোও জানা জরুরি।
খাদ্য ও কৃষিতে ব্যবহৃত উদ্ভিদ, প্রাণী এবং অনুজীবের জাত এবং জাতের ভিন্নতাই কৃষি প্রানবৈচিত্র্য। এদের মধ্যে রযেছে একটি আন্তঃনির্ভরশীল সম্পর্ক। কৃষক যে জমিতে চাষ করছেন সেই জমিতে যদি কোন অণুজীব না থাকে তাহলে হিউমাস সমৃদ্ধ হবেনা, মাটি উর্বরতা হারাবে, ফলন কম হবে। তাছাড়া যে কৃষক সরিষা চাষ করেন তা চালার জন্য দরকার হয় বাঁশের চালনা। যদি বাঁশ না থাকে তাহলে থাকবে না বাঁশ বেতের কাজ করা পেশাজিবী মানুষগুলো। কাজেই কৃষি টিকিয়ে রাখতে হলে বাঁশবেতের শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হবে, স্বীকার করতে হবে আন্তঃনির্ভরশীল সম্পর্ক। এখানে কৃষি ও বাঁশবেতে শিল্পের মধ্য আন্তঃনির্ভরশীল সম্পর্ক রয়েছে তা আমরা অস্বীকার করতে পারিনা। কৃষি জমিতে ব্যবহৃত ঝাটার উপর পাখি বসে। পাখি ক্ষতিকারক পোকা খেয়ে কৃষকের উপকার করছে। কমছে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার। আবার প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে নিজেদেরকে টিকিয়ে রাখাতে স্থানীয় জ্ঞান ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের সমস্যা সমাধান করছে। ব্যাঙ ঘন ঘন ডাকার মাধ্যমে মানুষ বুঝতে পারে কখন বৃষ্টি হবে। তাছাড়া ঘরের ভিতর মা মাচার খোটায় উইপোকা ডিপি করার মাধ্যমে জানতে পারেন বর্ষায় পানি কেমন হবে। বৃষ্টি হওয়ার জন্য গ্রামের মানুষ ব্যাঙের বিয়ে দিয়ে থাকেন। এখানে বৃষ্টির সাথে কৃষি কাজের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক।
অন্যদিকে মানুষে খাদ্যভাসে রুচির পরিবর্তন হলেও নিম্ন আয়ের মানুষের করোনা কালিন খাদ্য ঘাটতি পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখছে কোন রকম পরিচর্যা ও চাষাবাদ ছাড়া প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে উঠা উদ্ভিদগুলো। এই বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদগুলোর রয়েছে নানা পুষ্টিগুণ, প্রাকৃতিক ও নিরাপদ খাদ্য ভান্ডার। এই বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক উদ্ভিদে রয়েছ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রবেশাধিকার। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির চাহিদা পূরণে কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্য উৎসকে সংরক্ষণ করা জরুরি। কিন্তু এই বৈচিত্র্যময় খাদ্য ভান্ডার সংরক্ষণে কোন উদ্যোগ নেই। বরং এর প্রাকৃতিক উৎস নষ্ট করছেন এক শ্রেণীর মুনাফা লোভী মানুষ। প্রকৃতি, পরিবেশ, আন্তঃসম্পর্ক ও প্রাণবৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখার সঙ্গে সম্পদ সৃষ্টি ও দারিদ্র থেকে মুক্তির সম্পর্ক সরাসরি। প্রাণবৈচিত্রভিত্তিক কৃষি পদ্ধতি খাদ্যে সার্বভৌমত্ব অর্জনের পথ। আমাদের অস্তিত্বের প্রয়োজনে এবং স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের জন্য প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা করতে হবে। তাই আসুন নিজেদের টিকে থাকার জন্য সকল প্রাণের প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল হই এবং আন্তঃনির্ভরশীল সম্পর্ককে স্বীকার করি।