করোনা মোকাবেলায় যুব সংগঠনের উদ্যোগে বৈচিত্র্যময় সবজি বিতরণ
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
বৈশ্বিক দুর্যোগ মহামারী করোনা ভাইরাসে সারাবিশ্বের ন্যায় নাকাল বাংলাদেশও। প্রায় সতের কোটি জনগোষ্ঠীর এ দেশে ক্রমান্বয়ে আশংকাজনক হারে বেড়ে চলেছে মহামারী করোনার সংক্রমণ। করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী সরকার ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে ২০২০ পর্যন্ত লাগাতার প্রায় দুই মাস ধরে সরকারি/বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানের জন্য বিশেষ ছুটি ঘোষণা করে। পাশাপাশি সকল পরিবহন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমও বন্ধ ঘোষণা করে, যাতে সকলে নিজ নিজ ঘরে অবস্থান করে করোনা সংক্রমণ মোকাবেলা করতে পারেন। অপ্রয়োজনে কেউ যেন বাড়ির বাইরে না যান, সকলে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলেন। দেশের সকল লোক তাদের সাধ্যমত সরকারের নিষেধাজ্ঞা মেনে নিজ নিজ ঘরে অবস্থান নেয়, ব্যবসায়ীরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং পরিবহন বিভাগ সব পরিবহন বন্ধ করে দেয়, যাতে লোকেরা নিজ নিজ ঘরে থাকে। দীর্ঘ সময় এই হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকাকালীন সময়ে দেশের অতিদরিদ্র খেটে খাওয়া জনগোষ্ঠী কর্মহীন হয়ে চরম অর্থ কষ্টে দিন যাপন করতে বাধ্য হয়। সরকারি/বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন/প্রতিষ্ঠান ও জনগোষ্ঠী করোনা মোকাবেলায় বিভিন্ন ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। শহর ও গ্রামে ছোট-বড় অনেক জনসংগঠন (কৃষক, শ্রমিক, নারী, ছাত্র, যুব, সাংস্কৃতিক, জেলে সংগঠন) করোনা মোকাবেলায় হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকাকালীন সময়ে দরিদ্র ও অসহায় পরিবারগুলোর জন্য খাদ্য, ভাইরাস প্রতিরোধের উপকরণ ও নগদ অর্থ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন, যাতে তারা এই সময়টা মোটামুটিভাবে নিজেদেরকেঘরের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখতে পারে।
নেত্রকোনা জেলার সদর ইউনিয়নের দারুনবালী গ্রামের বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে গড়ে ওঠা “অক্সিজেন যুব সংগঠন” এমনই একটি সংগঠন। সংগঠনের মোট সদস্য সংখ্যা ২৫ জন। করোনাকালীন সময়ে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সংগঠনের সকল সদস্যই নিজ নিজ গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন। গ্রামে এসে তারা সংগঠনের সাংগঠনিক সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তারা দরনিবালী গ্রামটিকে একটি সবুজ গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সবুজ গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সংগঠনটি গ্রামের সকল বাড়িতে সজনে গাছ ও ঔষধি গাছের চারা রোপণ, বসতভিটায় সবজি চাষ, জ্বালানি সাশ্রয়ী চুলা বিতরণসহ বিভিন্ন ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করে।
গত ২৫ মার্চ থেকে হোম কোয়ারেন্টাইনে আসার পর সংগঠনের সকল যুব সদস্য বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানতে পারেন যে, শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি থাকলে এবং ভিটামিন ‘সি’ জাতীয় খাবার বেশি বেশি খেলে করোনা ভাইরাস তেমন কোন ক্ষতি করতে পারেনা। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি বা শরীরে এন্টিবডি তৈরির জন্য প্রয়োজন পুষ্টিকর খাবারের, যা বিভিন্ন তাজা শাক-সবজিতে বিদ্যমান। তাই সংগঠনের যুব সদস্যরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে গ্রামের সকল পরিবারকে বসতভিটার পতিত জমিতে বৈচিত্র্যময় সবজি চাষের পরামর্র্শ দেন। সংগঠনের উদ্যোগে তারা গ্রামের পতিত জমিতে বৈচিত্র্যময় সবজি (মিষ্টিকুমড়া, পুইশাক, করলা, কলমীশাক, শসা, ঢেড়স, ডাটা ইত্যাদি) চাষ করেন। এসব সবজি তারা গ্রামের ৩০০টি পরিবারের পুষ্টির চাহিদা পূরণ ও শরীরে এন্টিবডি তৈরির মাধ্যমে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে পর্যাক্রমে বিতরণ করেন। যুব সংগঠনটি বৈচিত্র্যময় সবজি সহযোগিতা দিয়ে গ্রামের ৩০০টি পরিবারের সবজির জন্য বাজারে যাওয়া নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছে, যা করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে সহায়তা করেছে। সংগঠনের সদস্যরা নিজের এসব সবজির বীজ সংরক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং গ্রামের সকলকে নিজেদের উৎপাদিত সবজির বীজ সংরক্ষণের পরামর্শ দিচ্ছেন, যাতে তারা বছরব্যাপী বসতভিটায় সবজি চাষ করে করোনা ভাইরাসসহ সকল ধরণের রোগবালাই প্রতিরোধের সক্ষমতা অর্জন করতে পারে। পাশাপশি সবজির জন্য বাজার নির্ভরশীলতা হ্রাস করে করোনাকালীন সময়ে ঘরের বাইরে না যাওয়া এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে গ্রামে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারে।
সংগঠনের নেতৃত্ব দানকারী যুবক পরাগ আহম্মেদ বলেন, ‘করোনাকালীন সময়ে সংগঠনের সব সদস্য হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে গ্রামে চলে আসায় আমরা এই সময়টা করোনা মোকাবেলায় গ্রামের পতিত জমিতে বৈচিত্রময সবজি চাষ করেছি। এসব সবজিসহ সকল সদস্যরা নিজ নিজ বাড়ি থেকে সবজি সংগ্রহ করে গ্রামের ৩০০টি পরিবারে বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছি, যাতে সকলে নিজ নিজ বসতভিটায় বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ করে খেয়ে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধের শারীরিক সক্ষমতা অজৃন করতে পারে।’
সংগঠনের যুব সদস্যরা গ্রামে বাইরের কোন লোক যেন প্রবেশ করতে না পারে এবং গ্রামের কোন লোক বাইরে যেতে না পারে সে দিকেও নজরদারী করছেন। তারা নিজেরাও করোনা প্রতিরোধে নিয়মিত শাকসবজি ও ভিটামিন ‘সি’ জাতীয় কাবার নিযমিত খাচ্ছেন এবং মাস্ক ব্যবহার, নিয়মিত সাবান বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাতধোয়া ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলছেন। করোনাকালীন সময়ে যুব সংগঠনের এমন মহৎ উদ্যোগ গ্রামের সকলকে করোনা প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখায় অনুপ্রাণিত করেছে।