বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ ও বীজ সংরক্ষণ করে করোনাকালীন সংকট মোকাবেলা করছে কৃষাণী মদিনা আক্তার
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমি:
কৃষির উৎপত্তির শুরু থেকে অদ্যাবধি গ্রামীণ নারীরা এখনও আপন মমতায় ও নিজেদের প্রয়োজনে, পরম যতেœ টিকিয়ে রেখেছেন বৈচিত্র্যময় জাতের শস্য ফসল ও শাকসবজির বীজ। নারীরাই টিকিয়ে রেখেছেন গ্রামীণ জীবনের বীজ বিনিময়ের সংস্কৃতি, সরবরাহ করছেন বিষমুক্ত নিরাপদ খাবার, পাশাপাশি সংরক্ষণ করছেন বৈচিত্র্যময় বীজ।
নেত্রকোনার সদর উপজেলার কাইলাটি ইউনিয়নের ফচিকা গ্রামের এমনই একজন কৃষাণী মদিনা আক্তার (৬৫)। বাড়িভিটাসহ তার মোট জমির পরিমাণ ৮০ শতাংশ। বাড়ির পাশে ৪০ শতাংশ জমিতে মদিনা আক্তার বছরব্যাপী বৈচিত্র্যময় সবজি ও মসলা জাতীয় ফসলের চাষ করেন। ৪০ শতাংশ জমিতে উৎপাদিত সবজি ও মসলা চাষ করে সারাবছর নিজে খাওয়ার পর উদ্বৃত্ত্বগুলো বাজারে বিক্রি করে যে আয় হয় তার উপর নির্ভর করেই মদিনার সংসার চলে। মদিনার সংসারের কেউ অন্য কোন চাকুরি বা অন্য কোন আয়বৃদ্ধিমূলক কাজ করে না। মাত্র তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করা মদিনার লেখাপড়া করতে না পারায় মনে খুব আক্ষেপ ছিল। বিয়ের পর তিনি স্বামীর বাড়ি চলে আসেন। স্বামীর বাড়িভিটাসহ মাত্র ৮০ শতাংশ জমি ছিল, যার মধ্যে চাষযোগ্য জমি মাত্র ৪০ শতাংশ। সামান্য জমি বলে মদিনা আক্তার হাল ছাড়েননি। বসতভিটাসহ ৮০ শতাংশ জমিতে বছরব্যাপী বৈচিত্র্য সবজি ও স্থানীয় জাতের কলা চাষ করে বিক্রি করে আয়ের টাকায় পরবর্তীতে তিনি আরো ৪০ শতাংশ জমি ক্রয় করেন।
মোট ৮০ শতাংশ জমিতে কৃষি ফসল চাষাবাদের আয় দিয়ে তিন সন্তানকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলছেন মদিনা আক্তার। তাঁর দুই মেয়ে ও এক ছেলে অনার্সসহ মার্ষ্টাস করেছে। আরেক ছেলে লেখাপড়া শেষ করে ব্যবসা করছেন। কৃষাণী মদিনা আক্তারের বয়স এখন প্রবীণের কোঠায়। প্রবীণ হলেও তিনি এখনও সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম নিজের হাতেই করেন। তিনি দীর্ঘ দিনের অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে মহামারী করোনা মোকাবেলায় পুষ্টি সমৃদ্ধ বৈচিত্র্যময় শাক্সবজি ও কলা চাষের কাজে লাগিয়ে কৃষি কাজকে আরও সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি খোয়ারের মুরগির বিষ্ঠা, গোয়ালের গোবর ও চুলার ছাই জমিতে ব্যবহার করে সম্পূর্ণ জৈব উপায়ে নিরাপদ শাকসবজি উৎপাদন করছেন। কোন ধরণের পোকামাকড়ের আক্রমণ না হওয়ায় সেই শাকসবজিতে কোন ধরণের কীটনাশক ব্যবহার করতে হয় না। নেত্রকোনা অঞ্চলের গ্রামীণ নারীরা বৈচিত্র্যময় শস্য ফসল চাষ করে, পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ গ্রহণ করে স্বনির্ভর কৃষি ব্যবস্থাসহ প্রাণবৈচিত্র্যকে সংরক্ষণের জন্য চালিয়ে যাচ্ছে নিরন্তর প্রচেষ্টা।
ছোট বেলায় তার মায়ের হাত ধরে বসতভিটায় সবজি চাষ, গবাদী পশু-পাখি পালন, অল্প জমিতে বছরব্যাপী বৈচিত্র্যময় ফসল চাষ করে সংসার চালানোর কৌশল সম্পর্কে মদিনা আক্তারের হাতেখড়ি হয়। মহামারী করোনাকালীন সময়ে কৃষাণী মদিনা আক্তার গ্রামের কিশোরী সংগঠনের সদস্যদের মাধ্যে বিভিন্ন ধরণের সবজি শস্য ফসলের বীজ যেমন- লাউ, মিষ্টিকুমড়া, মাসকালাই, লালশাক, মূলা, ডাটা, বারমাসি মরিচের চারা, পাঁচ জাতের শিম, পালং শাকের বীজ বিতারণ করেন। সংগঠনের কিশোরীদেরকে তিনি নিজের জীবনের ঘুড়ে দাঁড়ানোর গল্প শোনান, অল্প জমিতে কিভাবে সবজি চাষ করেন, লাউ মাঁচাতে উঠার পর নিচে ধনিয়া পাতা, লালশাক, ডাট চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে বলেন এবং তার সবজির বাগান ঘুড়ে দেখান।
মদিনা আক্তারের খোয়ারে বর্তমানে স্থানীয় জাতের ১৫০টি হাসঁ, ৬০টি মুরগি, ১০টি ছাগল ও গোয়ালে ৪টি গরু রয়েছে। এসব গৃহপালিত পশু-পাখির বিষ্ঠা, গোবর ও মল দিয়ে তিনি জৈব সার তৈরি করে কৃষি জমিতে ব্যবহার করেন। তিনি প্রতিদিন প্রায় ২০০ টাকার হাঁসের ডিম, ১২০ টাকার গাভীর দুধ বিক্রি করেন। মদিনা আক্তার বলেন, ‘আমি বিপদ-আপদের সময় হাঁস-মূরগি বিক্রি করি। করোনাকালীন সময়ে গ্রামের যারা ঢাকায় কাজ করত, তারা কাজ হারিয়ে এখন বেকার। কিন্তু আমি বেকার হইনি। আমার ব্যাংক হচ্ছে আমার বৈচিত্র্যময় সবজি, কলা, গরু, ছাগল, হাঁস ও মুরগি। আমি যে সবজি চাষ করি তাতে কোন প্রকার বিষ থাকে না, ফল, দুধ, ডিম, মাংস নিজেরা খেতে পারি বলে আমাদের শরীরে পুষ্টির অভাব নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার পরিবারসহ গ্রামের আরও চারটি পরিবারকে বাজার থেকে কিছু কিনে খেতে হয় না। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে আমরা বাকিগুলো বাজারে বিক্রি করি। করোনার পরিস্থিতিতে আমি নিজেই আমার গ্রামে ৬০টি পরিবারকে সবজি, সবজি বীজ ও পুকুরের মাছ দিয়ে সহযোগিতা করেছি। করোনাকালীন সময়ে আমার সন্তানেরা বাড়ি থাকায় তারাও আমাকে কাজে বেশ সহযোগিতা করছে। তাই করোনাকালীন সংকট মোকাবেলা করতে আমার কোন সমস্যা হচ্ছে না।’
কৃষাণী মদিনা আক্তার বলেন, ‘আমার উৎপাদিত সবজির বাজার মূল্যই আলাদা। আমাকে বাজারে নিয়ে সবজি বিক্রি করতে হয় না, বাড়ি থেকে পাইকার এসে সবজি নিয়ে যায়। জৈব উপায়ে চাষ করায় আমি অন্যান্য কৃষকের চেয়ে সবসময় বেশি দামে সবজি বিক্রি করি। আমার স্বপ্ন ছিল যে, আমি নিজের প্রয়োজনীয় সবজি ও শস্য ফসলের বীজ নিজেই সংরক্ষণ করবো, গ্রামের অন্যদেরকে বীজ দিয়ে সহায়তা করবো এবং জৈব উপায়ে সবজি চাষ করতে অন্যদেরকে সহযোগিতা করবো। আমার সেই স্বপ্ন আজ সফল হয়েছে, আজ আমি স্বার্থক। আমার ছেলে মেয়েকে মানুষের মত মানুষ করে গড়ে তুলেছি। এখন একটি চাওয়া যে, আমার ছেলে-মেয়েরা ভালো চাকুরি করবে, মেয়েদেরকে ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দেয়া। আমার গ্রামের কৃষক-কৃষাণীরা যেন তাদের প্রয়োজনীয় কৃষি বীজের জন্য প্রতারিত না হয়। তাই আমার বাড়িতেই আমি একটি গ্রামীণ বীজ ঘর গড়ে তুলতে চাই।’