পরিবেশ ভালো না থাকলে মানুষসহ কেউ ভালো থাকতে পারে না
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মানুষ আজ গভীর সংকটে, পরিবেশ আজ বিপর্যস্ত প্রায়। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়ছে উদ্ভিদসহ সকল প্রাণীকূলের উপর। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের সাথে সাথে প্রাকৃতিক দুর্যোগেও ব্যাহত হচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা, কৃষি ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য। পরিবেশ সুরক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় দেশের প্রায় সকল অঞ্চলের জনগোষ্ঠী, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি/বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি উদ্যোগে নেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন ধরণের উন্নয়ন উদ্যোগ।
নেত্রকোনা জেলায় কাইলাটি ইউনিয়নের অরঙ্গবাদ গ্রামের ‘উদয় যুব সংগঠন’ করোনাকালীন পরিস্থিতিতে নিজ এলাকার পরিবেশ উন্নয়ন, পরিবেশ সুরক্ষা, নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চা ও স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধিতে ছোট ছোট উন্নয়ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সংগঠনটি নিজ গ্রাম ও সমাজের জনগোষ্ঠী ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের পরিবেশ সুরক্ষায় উদ্বুদ্ধ করতে বিভিন্ন ইস্যুতে জনসচেতনতামূলক প্রচারণা পরিচালনা করে আসছে। নেত্রকোনা সদর উপজেলার ‘কাইলাটি একতা উচ্চ বিদ্যালয়’র শিক্ষার্থীদের কৃষি-প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ, জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে অভিযোজন, অচাষকৃত উদ্ভিদ সংরক্ষণ, পরিবেশ সংরক্ষণে বৃক্ষ রোপণসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বক্তৃতা মালা ও প্রচারণাভিযানের আয়োজন করে আসছে।
করোনা ভাইরাস সংক্রমণ রোধে সরকারের নির্দেশে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ‘অরঙ্গবাদ যুব সংগঠন’র উদ্যোগে এলাকার পরিবেশ উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় নতুন প্রজন্মের সচেতনা ও যুক্তকরণের পাশাপাশি এলাকায় বৈচিত্র্যময় গাছের চারা রোপণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে সম্প্রতি। দেশীয় ফলদ ও ঔষধি গাছের চারা রোপণ করে এলাকার পরিবেশ সুন্দর করার পাশাপাশি বিষমুক্ত নিরাপদ ফল উৎপাদন ও সহজলভ্যকরণই যুব সংগঠনটির বৃক্ষ রোপণের অন্যতম লক্ষ্য। লক্ষ্য অর্জনে যুব সংগঠনটি কাইলাটি ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রামের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও যুবদের অংশগ্রহণে মাসব্যাপী বৃক্ষ রোপণ কর্মসূচির আয়োজন করে। এলাকার স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি (মেম্বার), প্রবীণ ব্যক্তি, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, যুব ও কিশোর-কিশোরীসহ এলাকার সকল শ্রেণীর জনগোষ্ঠী স্বাস্থ্যবিধি মেনে এলাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাজার ও বাড়িতে বারসিক’র সহযোগিতায় ৩০০টি ফলদ ও ঔষধি গাছের চারা রোপণ করেন এবং গবাদী পশু থেকে চারা রক্ষায় বেড়া তৈরি করে দেয়ন। এছাড়াও অরঙ্গবাদ ‘উদয় যুব সংগঠন ও শীতল পাটি কৃষাণী সংগঠন’র উদ্যোগে গ্রামের বিভিন্ন পরিবার ও পতিত স্থানে ১০০টি ফলজ ও ৫০টি ঔষধি গাছের চারা রোপণ করা হয়।
এই প্রসঙ্গে যুব সংগঠনের অন্যতম সদস্য শিক্ষার্থী আব্দুল আলিম বলেন, ‘পরিবেশ ভালো না থাকলে আমরা মানুষসহ কোন প্রাণীকূল স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে পারবনা। পরিবেশ অর্থাৎ গাছ আমাদের জীবন, তাই আমাদের প্রয়োজনেই পরিবেশের অন্যতম উপাদান গাছকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। আমরা নিজ নিজ উদ্যোগে ও সাংগঠনিক উদ্যোগে প্রতিবছর সামর্থ্য অনুযায়ী স্থানীয় জাতের ফলদ ও ঔষধি গাছ লাগাবো। পরিবেশ সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করবো, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে (বিবাহ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠন বা খেলাধুলা প্রতিযোগিতায়) পরিবেশ সুরক্ষার প্রচারণা স্বরূপ স্থানীয় গাছের চারা পুরষ্কার হিসেবে দেব।’ তিনি আরও বলেন, ‘মহামারী করোনা মোকাবেলায় পুষ্টির চাহিদা পূরণে আমরা সংগঠনের উদ্যোগে গ্রামের ১০০টি পরিবারকে ১০০টি পেঁপে চারা দিয়ে সহযোগিতা করেছি। ্আমারা রোগবালাই থেকে রক্ষায় সকলকে বিষমুক্ত ফল ও সবজি চাষ করে খাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করছি। পাশাপাশি এলাকার পরিবেশ রক্ষা ও উন্নয়নে প্রতিবছর ১০০টি করে ফলের চারা রোপণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
কিশোরী সুরমা আক্তারের মতে, ‘নিজ নিজ এলাকার পরিবেশ নিজেদেরই রক্ষা করতে হবে। আমাদের গ্রামের পরিবারগুলোতে ফলদ ও ঔষধি গাছের সংখ্যা খুবই কম, আমরা প্রতি মৌসুমে প্রয়োজন মত ফল খেতে পারি না। ফলে আমাদের শরীরে পুষ্টির অভাব দেখা যাচ্ছে এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এলাকায় ফলের উৎপাদন বাড়াতে তাই সকল পরিবারকে নিজ উদ্যোগে বৈচিত্র্যময় ফলদ ও ঔষধি গাছের রোপণের উদ্যোগ নিতে হবে।’
গ্রামের একজন প্রবীণ অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বলেন, ‘আমরা আগে কখনও বাজারের ফল, মাছ, তরকারি কিনে খাইনি, নিজেদের উৎপাদিত রাসায়নিকমুক্ত ফল ও সবজি খেয়েছি। তাই আমরা এখনও সুস্থ জীবনযাপন করছি। সবাই একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করলে আমরা যেমন নিজেরা ভালভাবে বাঁচবো, তেমনি অন্যদেরও বাঁচাতে পারবো। ফলদ, ঔষধি ও কাঠ জাতীয় গাছ রোপণ করা এবং সকলের বসতবাড়ির আঙ্গিনায় বিষমুক্ত সবজি চাষ বাড়াতে হবে। নিজ গ্রামকে সুন্দর ও উন্নত করতে আমরা প্রবীণরাও তোমাদের সাথে আছি এবং থাকবো। যুবদের এই উদ্যোগ সুন্দর শৈশব গঠনে ভবিষ্যত প্রজন্মকে সুন্দরভাবে গড়ে উঠতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।’
এলাকার পরিবেশ ও সমাজ উন্নয়নে যুবদের এ ধরণের মহৎ উদ্যোগে সকলে সহায়তার হাত বাড়ালে এলাকার জনগোষ্ঠী যেমন নির্মল পরিবেশে জীবনযাপন করতে পারবেন, তেমনি রোগ নিরাময়ে স্থানীয় ও লোকায়ত চর্চার সুযোগ তৈরি হবে। পাশাপাশি ভবিষ্যত প্রজন্ম প্রাকৃতির সাথে বেড়ে ওঠার সুযোগ পাবে এবং তাদের পুষ্টির চাহিদা পূরণ হবে।