খাদ্য চাহিদা পূরণে কৃষিকাজের বিকল্প নেই
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। এদেশের শতকরা ৮০ ভাগ লোকই কম বেশি কৃষি কাজের সাথে যুক্ত। সেই প্রাচীনকাল থেকে আমাদের অর্থনীতিতে কৃষি ও কৃষকের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কৃষিকে বাদ দিয়ে কোন কিছু কল্পনা করা যায় না। সবকিছু কৃষির সাথে যুক্ত। আর এই কৃষি কাজকে পুঁজি করে আমাদের অর্থনৈতিক চাকা সচল রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ আমাদের কৃষি কাজকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নানানমূখী কর্মসূচি গ্রহণ করে চলেছে। এটা আমরা সকলেই ভালোভাবে জানি যে, এদেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে কৃষির গুরুত্ব অনেক। বাংলাদেশ যে দুর্যোগ ঝুকিপূর্ণ একটি দেশ এখানে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ লেগে থাকে। সাথে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, মাটির উর্বরতা হ্রাস এবং পরিবর্তিত পরিবেশের প্রেক্ষাপটে আমাদের বিশাল এই জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টি নিশ্চিৎকরণ যেন দিনকে দিন কঠিন হয়ে পড়েছে। সাথে করোনা নামক মহামারী যুক্ত হয়ে জনজীবনকে দুর্বিসহ করে তুলেছে। বিভিন্ন ধরনরে সমস্যা মোকাবেলা করে আমাদের খাদ্য ও পুষ্টি নিশ্চিৎ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
করোনাকালের এসময়ে সকল পেশার মানুষের কাজের সংকট দেখা দিয়েছে। এ কাজের সংকটের কারণে খাদ্য ঘাটতি দেখা দেওয়ার উপক্রম হচ্ছে। কৃষকেরা তাদের কৃষি কাজকে সমানের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছেন না। শত বাধাকে অতিক্রম করে আস্তে আস্তে সেখান থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন পেশার মানুষ যেমন তাদের স্ব স্ব কাজে ফিরছে তেমনি কৃষক করোনা সময় যেমন তাদের পেশার কাজ করে গেছেন এবং এখনও সেইভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্য পেশার মতো কৃষক যদি তার কৃষি কাজকে এই সংকটকালীন মুহুর্তে বন্ধ রাখতো তাহলে হয়তো বা আমাদের কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হতে হতো। খাদ্যের জন্য হয়তোবা কোন যুদ্ধ বা নুতুন কোন সংগ্রাম শুরু হয়ে যেতো। সেখান থেকে আমরা কিছুটা হলেও বেরিয়ে আসতে পেরেছি বা চেষ্টা করছি। কিন্তু তারপরও সামনের দিনগুলো যে আরো কঠিন হয়ে উঠবে নাকি ভালো যাবে সেটাও বলা কঠিন। আমাদের কৃষি কাজকে কৃষি পেশার জন্য হয়তোবা আমরা মহামারীর এই চরম মুহুর্ত কিছুটা হলেও কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছি।
বিগত সময়ে মাঠ পর্যবেক্ষণে উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে একক বা দলীয়ভাবে কথা হলে উপরোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়। এছাড়াও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কাছে তাদের করোনাকালীন সময়ে কৃষিকাজকে কিভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বা কি ধরনের সমস্যার সন্মূখীন হচ্ছেন তা জানতে চাওয়ার চেষ্টা করা হয়।
সেক্ষেত্রে কালমেঘা গ্রামের প্রবীণ কৃষক প্রফুল্ল মন্ডল, কৃষাণী বাসন্তী রানী ও কাচড়াহাটি গ্রামের কৃষাণী সুমিত্রা রানী বলেন, ‘আমরা আগে অনেক ধরনের দুর্যোগ দেখেছি। কিন্তু তার মধ্যে করোনা দুর্যোগ ছিলো খুবই কঠিন। এ এমন এক দুর্যোগ যে কারো কাছে যাওয়া যাবেনা। বাইরের কোন কাজ করতে পারবো না। আমরা কৃষক মানুষ প্রতিনিয়ত আমাদের বাইরে যেতে হয়। একদিন না খাটলে চলেনা। আর এ সমস্যার মধ্যে দিয়েও আমরা বসেছিলাম না। আমরা আমাদের কৃষি কাজকে চালিয়ে গেছি। যে কোন দুর্যোগ হোক না কেন আমরা কৃষকেরা কোন সময় বসে থাকি না। প্রতিনিয়ত সব কিছু মোকাবেলা করে থাকি। সেটা হোক কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মানবসৃষ্ট দুর্যোগ কিংবা করোনার মতো মহামারী। সবকিছুকে তোয়াক্কা করে আমরা ফলন ফলাই। আমরা কৃষকেরা মনে করি যে, আমরা যেমন নিজেদের খাদ্য ঘাটতি মিটাচ্ছি তেমনি আমরা অন্যের খাদ্য ঘাটতি মিটাচ্ছি।’
তারা আরও বলেন, ‘আমরা যে পৃথিবীর বহু প্রাণীর খাদ্যের জোগান দিচ্ছি সেটা ভাবলে নিজেদের ভালো লাগে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে আমরা আমাদের সেই ন্যায্যমূল্য সম্মান পাই। মহামারী করোনার সময় আমরা নানান ধরনের সমস্যার সম্মুখিন হয়েছিলাম। সে সমসয় কিন্তু আমাদের একে অন্যের বাড়ি যাতায়াত কম ছিলো। পানির জন্য হাহাকার করতে হয়েছে, সর্দি কাশি হলে সেটাকে করোনা ভাবতে ছিলাম, অসুস্থ হলে ভালো ডাক্তারের পরামর্শ নিতে পারিনি, নিজেদের তৈরিকৃত সবজি বিক্রি করতে পারিনি, অনেকে কাজ করতে পারিনি। এতে করে খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছিলো। সেই কঠিন সময়টা আমরা পার করেছি খুবই ভয় ভোগান্তির মধ্যে দিয়ে। সেসময় যার খাদ্য ছিলো সে তার বাড়ির আশেপাশের মানুষকে সহায়তা করেছে। আমরা যারা ফসল উৎপাদন করি সেখানেও আমরা ধান, সবজি, মাছ, মসলা দিয়ে একে অপরের সাহায্য করেছি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করেছি। আমরা যদি এভাবে ঝুঁকি নিয়ে খাদ্য উৎপাদন না করতাম তাহলে হয়তোবা কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হতে হতো।’
এ প্রসঙ্গে কালমেঘা গ্রামের কৃষাণী বনশ্রী রানী বলেন, ‘আমরা কঠিন একটা সময় পার করেছি। আমরা প্রতিনিয়ত যেমন ফসল চাষ করি এই সময়ও ঠিক একইভাবে ফসল উৎপাদন অব্যাহত রেখেছিলাম। এই সময়ে আমাদের যার যতটুকু জায়গা ছিলো সব জায়গায় কম বেশি করে সবজি লাগিয়েছিলাম। করোনাকালীন সময়ে গ্রামের প্রায় ১৭০ জনকে সবজি, ইউনিয়ন পরিষদ ও বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠান থেকে খাদ্য, বীজ, চারা, সাবান পেতে সহায়তা করেছি। এই সময় যদি আমরা কৃষকেরা ভয়ে সবকিছু বন্ধ করে রাখতাম তাহলে আমরা যেমন বিপদে পড়তাম তেমনি আমাদের কাছ থেকে যারা ফসল ক্রয় করে তারাও বিপদে পড়তো। বর্তমান সময়ে আমার বাড়িতে কৃষির সব কাজ প্রায় হয়। ধান ও সবজি চাষ, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল ও কবুতর পালন করি। পুকুর ও ঘেরে বিভিন্ন ধরনের মাছ চাষও হয়। বিগত সময়ে বারসিক যে শত বাড়ি তৈরির কাজ করছে। সেখানে আমার বাড়ি নির্বাচন হয়েছে। তারা বিভিন্ন ধরনের উপকরণ সহায়তা ও যোগাযোগ চলমান রেখেছে।’
সবকিছুর মূলে যেমন খাদ্য। তেমনি খাদ্যের চাহিদা পূরণ হয় কৃষি কাজের মাধ্যমে। বর্তমান সময়ে যে করোনা মহামারী সেখান থেকে বের হয়ে কৃষক কৃষি কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। কৃষির ওপরই দেশের অর্থনৈতিক অনেকাংশ নির্ভরশীল বিশেষ করে দেশের খাদ্য চাহিদা মেটাতে বিপুল পরিমাণ খাদ্য শস্যের দরকার হয় আর তা আসে কৃষি কাজ ও কৃষি জমি থেকে। তাই কৃষিখাতকে আরও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত।