উপকূলীয় বেরী বাঁধগুলো মজবুত করার দাবি
সাতক্ষীরা,শ্যামনগর থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
‘আমরা উপকূলীয় এলাকার মানুষ। প্রতিনিয়ত নানান ধরনের দুর্যোগের সাথে আমরা পরিচিত। এ দুর্যোগ বিগত সময়ে পাতলা হতো দু’চার বছর পর পর। আর এখন যতই দিন যাচ্ছে ততই যেন ঘন ঘন হতে শুরু করেছে। একটা দুর্যোগ হওয়ার পর তার রেশ কাটতে না কাটতে আরেকটি এসে হাজির হচ্ছে। এখন তো বছরে ঘুরে ফিরে দু-তিনবার করে হচ্ছে। মাথা তুলে দাঁড়ানোর সময় দিচ্ছেনা। দুর্যোগ হলে আগে আমাদের মোকাবেলা করতে হয় লবণ পানির সাথে। কারণ আমাদের এলাকার বেরী বাঁধগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। এখানে যেমন তেমন কোন দুর্যোগে ঝড়, বৃষ্টি হলেই রাস্তা ভেঙে, রাস্তা ছাপিয়ে ভিতরে পানি প্রবেশ করে। এ পানি হলো লবণ ও বিষাক্ত, যা একবার ভিতরে ঢুকলে সব শেষ করে দেয়। এই লবণ পানিকে আমরা এসিড বলি। এ এসিড পানি বন্ধের একমাত্র উপায় হলো মজবুত বেরীবাঁধ। যদি রাস্তা ও বেরী বাঁধগুলো মজবুত হতো তাহলে লবণ পানির প্রকোপ কম হতো। তাতেই আমরা আমাদের বসত ভিটায় সবজি, ফলজ গাছ, কৃষি জমিতে ধান, স্থানীয় বিভিন্ন ধরনের মাছ, বিভিন্ন ধরনের গবাদী পশু পালন করতে পারতাম।’
উপরোক্ত কথাগুলো বলেছেন পুর্ব কাশিমাড়ি গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক রাকিবুল আলম। গতকাল বারসিক’র সহায়তায় কাশিমাড়ি ইউনিয়নের সুন্দরবন স্টুডেন্ট সলিডারিটি টিমের উদ্যোগে ১২৬ নং পুর্ব কাশিমাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কক্ষে ঝাপালী গ্রামের স্থানীয় জনগোষ্ঠীদের নিয়ে উপকূলীয় টেকসই বেরীবাঁধ তৈরিতে করণীয় বিষয়ক আলোচনায় ও তথ্য সংগ্রহে উপরোক্ত কথাগুলো বলেন তিনি।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ করেন ঝাপালী ও কাশিমাড়ি গ্রামের কৃষক-কৃষাণী, জেলে, মৎস্যজীবী, বনজীবী, ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী ও বারসিক কর্মকর্তাসহ ৪ জন নারী ও ৯ জন পুরুষ সহ মোট ১৩ জন।
সভায় অংশগ্রহণকারীরা জানান, ‘বেরি বাঁেধের ইতিহাস বলা খুবই কঠিন। তবে ধারণা করা যায় যে ১৯৫৬ সালের দিকে বেরি বাঁধের রাস্তা শুরু হয়। তা সরকারিভাবে নয়। স্থানীয় জনগোষ্ঠী তাদের নিজেদের প্রয়োজনে তৈরি করেছিলেন, যাতে নদীর পানি ভিতরে প্রবেশ না করে। এ রাস্তা ছিলো খুবই ছোট। এভাবে আস্তে আস্তে বেরি বাঁধ শুরু হয়। তারপর সরকারিভাবে শুরু হয়। প্রতিবছর নদীর মধ্যে বেরি বাঁধ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আমরা দেখেছি আমাদের এখানে তিনটি বেরি বাঁধের রাস্তা নদীর মধ্যে চলে গেছে। বর্তমান বেরি বাঁধের অবস্থা খুবি নাজুক। এখানে প্রায় ৩০ বছরের মতো মাটি পড়েনি। শুধুমাত্র যেখানে ভেঙেছে সেখানে মাটি দেওয়া হয়েছে। বর্তমান আমাদের বেরি বাঁধগুলো কোথায় ২ হাত, ৩ হাত, ৬ হাত আবার কোথায শুধু বালি ভর্তি একটা বস্তা দেওযা এরকম ভাবে আছে।’
তারা আরও জানান, ‘এলাকাতে বসবাসের জন্য রাস্তা মজবুত করা খুবই জরুরি। রাস্তা এমনভাবে তৈরি করা উচিৎ যাতে ১০০-১৫০ বছর ভালো থাকে। তার জন্য সঠিক পরিকল্পনা তৈরি করা দরকার। বেরির রাস্তাগুলো উচ্চতা ২০-২৫ ফুট, নিচেয ৬০ ফুট ও উপরে ৩০ ফুট হওয়া দরকার। রাস্তার নদীর পাশে বøক করে পাথর দিযে কার্পেটিং করতে হবে। আর ভিতরের পাশে ঘাস লাগানো। এছাড়া নদীর চরে ১৫০ ফুট জায়গা রেখে বেরিবাঁধ তৈরি করা এবং নদীর চরে ও রাস্তার উপরে বিভিন লবণ সহনশীল গাছের বনায়ন করা করা দরকার।’
অংশগ্রহণকারীরা জানান, ‘বেরিবাঁধের ভিতরের খালগুলো পুনঃখনন এবং উন্মুক্ত করতে হবে। খালগুলোর সাথে স্লুজ গেট স্থাপন থাকবে, যা দিযে যেমন চিংড়ি ঘেরের পানি উঠবে। তেমনিভাবে ঘেরের পানি ও বর্ষার পানি বের হতে পারবে। এছাড়াও চিংড়ি ঘেরের জন্য ওভার পাইপের ব্যবস্থা করা দরকার।’
অংশগ্রহণকারী আবুল বাসার, মুসলিমা ও গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘এলাকায় দুর্বল বেরিবাঁধের কারণ আমাদের ভোগান্তির শেষ নেই। বেরিবাঁধের কারণে আমরা নানান সমস্যায় জর্জারিত। প্রতিনিয়ত ভাঙছে ও লবণ পানি প্রবেশ করছে। এতে করে আমাদের চিংড়ি ঘেরগুলো ডুবে মাছ বের হযে যাচ্ছে, মাটির ঘরগুলো ভেঙে যাচ্ছে, দালান ঘরে মরিচা ও নোনা ধরছে, সবজি চাষ করতে পারছিনা, ফলজ গাছ মারা যাচ্ছে, গবাদি পশু পালন করতে পারছিনা, নিরাপদ খাবার পানির অভাব দেখা দিচ্ছে, বিনোদন কমে যাচ্ছে, নানান ধরনরে অসুখ বিসুখ হচ্ছে, ছেলে মেয়েরা লেখা পড়া করতে পারছে না ঠিক মতো। কারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকছে সেগুলো আশ্রয়ন প্রকল্প হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে, দেশীয় মাছের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে, যোগাযোগের সমস্যা এরকম শত শত সমস্যা হয় আমাদের। প্রশাসনের নিকট আমাদের সকলের দাবি আমাদের উপকূলীয় এই বেরি বাঁধগুলো মজবুত করে আমাদের টিকে থাকতে সহায়তা করুন। তা না হলে এক সময় হয়তোবা আমাদের শেষ আশ্রয়স্থলটুকু হারাতে হবে।’