পরিবারের আয় রোজগারের প্রধান ভূমিকায় একজন প্রবীণ
রাজশাহী থেকে মো. শহিদুল ইসলাম
এখন মাঘের শীত। সকাল বেলা। চারিদিকে হালকা হালকা কুয়াশাঘেরা আর শির শির বাতাসে শীতের প্রকোপ আরো বেড়েছে। এই ভরা শীতেও একজন প্রবীণ তাঁর বাড়ির পালানি জমিতে শাকসবজির ক্ষেতে বসে বসে নিড়ানি দিচ্ছেন। শীতের এই সময়ে হয়তো তাঁর ঘরের ভিতরে চাঁদরের উষ্ণতায় মোড়ানো আরাম করার কথা ছিলো। কিন্তু শরীর স্বাস্থ্য ভালো থাকায় একই সাথে জীবনের প্রয়োজনে তাঁকে জমিতে কাজ করতে হচ্ছে। তবে এতে তাঁর অনুভূতিতে কোন আফসোস সেই। নেই কোন কষ্ট। কারণ তিনি সুস্থ আছেন এবং তিনি কাজ করতে পারছেন তাতেই তিনি শুকরিয়া জানান।
কথাগুলো বলছিলাম রাজশাহী জেলার পবা উপজেলার নওহাটা পৌরসভার ভুগরোইল গ্রামের প্রবীণ মোজাম্মেল হককে (৭০) নিয়ে। মোজাম্মেল হকের বয়স বাড়লেও তিনিই এখনো তাঁর পরিবারের আয় রোজগারে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। তাঁর আদি নিবাস ছিলো নাটোর জেলায়। জীবিকার সন্ধানে সেই ৩৫ বছর আগে রাজশাহী শহরে এসেছিলেন মোজাম্মেল হক। সেই সময়ে নাটোর জেলা থেকে অভাব অনটনের কারণে রাজশাহী শহরে পারি জমান পরিবার পরিজন নিয়ে। রাজশাহী শহরে এসে তিনি রিকসা চালিয়ে সংসারের খরচ চালাতেন। তিনি বর্তমান ৫ ছেলে এবং ৫ মেয়ের জনক। পরিবারের মোট সদস্য ১২ জন। ছেলে মেয়েদের বিয়ে হয়ে এখন আলাদা পরিবার গঠন করেছেন। দিনে দিনে বয়সের ভারে এখন আর রিকসা চালাতে পারেননা বা শরীরের বেশি শক্তি লাগে এমন ভারি কাজও করতে পারেন না। এদিকে ছেলেরা বড় হয়ে বিয়ে করে আলাদা পরিবার গঠন করে অন্য এলাকায় বসবাস করেন। মোজাম্মেল হকের নিজের কোন জমিও নেই। পরের জমিতে থাকেন। তাঁর বাড়ির আশপাশেই মানুষের পালানি জমিতে শাক সবজি ও ফলমুলের চাষাবাদ করে সংসার চালান এখন।
করোনাকালে চারিদিকে যখন কাজ কাম বন্ধ এবং কোথাও যাবার সুযোগ নেই, তখনই তিনি আরো মনোযোগী হন তার বসতবাড়ির আশে পাশে পড়ে থাকা জমিগুলোর প্রতি। যদিও সেসব জমি তাঁর নিজের নয়। কিন্তু জমিগুলো বছরের পর বছর অব্যহৃত বা পড়েই থাকে। তিনি বুদ্ধি করে জমির মালিকদের ফোনে সেখানে শাকসবজি ফলমুল চাষের অনুমতি নেন। ২০২০ সালের প্রথম থেকে তিনি তাঁর বাড়ির আশপাশে পড়ে থাকা সকল জমিতে বিভিন্ন ধরনের সবজি ও ফলমুলের পরীক্ষামূলক চাষাবাদ শুরু করেন। এত তিনি ভালো ফলাফল পান। করোনাকালিন লকডাউনের সময় শহরে যখন গ্রাম থেকে শাকসবজি নিয়ে কৃষকগণ শহরে আসতে পারতো না নানা সীমাবদ্ধতার কারণে। তখন মোজাম্মেল হক তাঁর উৎপাদিত শাকসবজি শহরের বাজারে অনায়াসেই বিক্রি করতে পারতেন। কারণ শহরের নিকটেই উপশহরেই তাঁর সবজি বাগান হওয়ায় তিনি এই সুবিধা পেয়েছেন। তাঁর মতে, সেই সময় প্রতিদিন তিনি বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি বিক্রি করে আয় করতেন তিনশত থেকে চারশত টাকা। মাসে প্রায় গড়ে বারো হাজার থেকে পনেরো হাজার টাকা আয় করতেন। করোনার এই আয় দিয়ে তাঁর সংসার চলে ভালো।
দিনে দিনে মোজাম্মেল হক তাঁর পাবারিক সবজি ও ফলের বাগানটি আরো সমৃদ্ধ করেছেন। মৌসুমভিত্তিক নানা জাতের শাকসবজি এবং ফলমূলে চাষাবাদ করছেন। এর উপর তিনি এক বিঘার একটি জমি বাৎসরিক ভিত্তিক বন্ধক নিয়ে এবার গমের চাষ করেছেন। পর্যবেক্ষণকালে দেখা যায়, মোজাম্মেল হক ১০টি প্লটে প্লট আকারে বেগুন, টমেটো, লাল শাক, দেশি তিন জাতের সীম, কলা, লাউ, কলমি শাক, রসুন, ধনিয়া চাষসহ নানা জাতের শাকসবজি ও ফলমূলের গাছ লাগিয়েছেন।
তাঁ বাড়িতে এখন তিন জাতের (শবড়ি কলা, জিন কলা, দেশি সাগড় কলার) কলার গাছও রয়েছে। নিয়মিত সেখান থেকে তাঁর আয় হয়। তিন জাতের দেশি সীম যেমন চিকন লাল সীম, ছোট সীম, চ্যাপ্টা সীমমের আবাদ করেছেন। তিনি মিশ্র পদ্ধতিতে একই সাথে টমেটো, মরিচ, কলা, লাল শাক, সবুজ শাক, বন আলুর চাষ করেছেন।
মোজাম্মেল হক তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে এই সবজি বাগান গড়ে তুলেছেন। তিনি একজন কৃষকের সন্তান হওয়ায় শৈব, কৈশর এবং যৌবনকালে কৃষি কাজ করতেন। সেই অভিজ্ঞতা তিনি কাজে লাগাচ্ছেন। বসতবাড়িতে সবজি বাগান করতে শুরুতে তাঁর এই কাজে সহায়তা করেন উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক। তিনি বলেন, ‘বারসিক আমাকে বীজ এবং উপকরণসহ নানা পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেছে বলেই আমি পরিকল্পিতভাবে এই কাজটি সফলভাবে করতে পাচ্ছি।’ ভুগরোইল গ্রামের এই কাজের সাথে যুক্ত ও সহায়তাকারী বারসিক’র সহযোগী কর্মসূচী কর্মকর্তা ব্রজেন্দ্র নাথ বলেন, ‘মোজাম্মেল হক একজন দক্ষ এবং আগ্রহী প্রবীণ, তিনি আমাদের পরামর্শ মতো বাড়িতেই একটি সমৃদ্ধ সবজি ও ফলের বাগান গড়ে তুলেছেন, এই বাগান থেকেই তাঁর পরিবারের সকল খরচ চলে। তাঁকে আর কারো কাছে সহযোগীতা চাইতে হয় না।’
প্রবীণ মোজাম্মেল হক তাঁর দীর্ঘ সময়ে কৃষি অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব উপায়ে যেমন বিভিন্ন শাকসবজি উৎপাদন করে নিজের পরিবারের একজন প্রধান আয় উপার্জনকারী মানুষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, তেমনি তাঁর এই পরিবেশবান্ধব উপায়ে শাকসবজি ও ফলমুল খেয়ে মানুষেরও রোগবালাই কম হবে একই সাথে প্ররিবেশ প্রতিবেশ রক্ষায় অসামান্য অবদান রাখছেন।