দেশটারে ভালোবাইস্সা সোনার বাংলাই বানাইলাম

নেত্রকোণা থেকে তবারক হোসেন

নাম তার ফজলু মিয়া (৬৩)। পেশায় আনসার। প্রায় ৪১ বছর ধরে তিনি কাজ করে গেছেন এই পেশাতে থেকেই। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দু’সন্তানের জনক। এক ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে তাঁর সংসার। দুর্গাপুর উপজেলার চন্ডিগড় ইউনিয়নের নাগেরগাতি গ্রামের ফজলু মিয়া গ্রামের স্কুলে পড়াশুনা করেছেন ৪ ক্লাশ পর্যন্ত। শিক্ষাগত জায়গা থেকে বেশি দূর আগাতে না পারলেও সততা আর নৈতিকতার মানদন্ডে তিনি বহুদূর এগিয়ে গেছেন। তিনি দেশটাকে ভালোবেসে সোনার বাংলা বানাতে চান। তাঁর স্বপ্ন একজন আদর্শ দেশপ্রেমিক হওয়া আর সমাজটাকে পাল্টে দেয়া।
Fojlu - 02 (1)
সম্প্রতি নির্বাচন নিয়ে কাজ করার সুবাদে দেখা হয় এই ফজলু মিয়ার সাথে। গত ২৮ মে দুর্গাপুর উপজেলায় ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন ভোট দেয়াকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের মাঝে তুমুল ঝগড়া-মারামারি হচ্ছিল, সেখানেই সাহসী ফজলু মিয়াকে দেখতে পাই যিনি পুলিশের থেকেও অধিক সাহস নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা করছিলেন। এই সময় তিনি রাস্তায় একটি মোবাইল সেট ও একটি মানিব্যাগ কুড়িয়ে পান। এটি দেখে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম মানিব্যাগ খুলে দেখেননি কি আছে তার মধ্যে বা মোবাইলেও কি কোন কল আসেনি? উত্তরে তিনি বলেন, “কেন দেখবো এগুলো কি আমার?” প্রত্যুত্তরে বলি, তবে নিজের কাছে রেখেছেন কেন? তিনি উত্তর দেন, “নির্বাচন শেষ অইলে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়াম, যেইলা উহযুক্ত প্ররমাণ দিবো তাঁরেই হিরত দিয়াম।”

আমি দুর্গাপুর চলে আসার প্রাক্কালে ফজলু মিয়া আমার ফোন নাম্বার রাখলেন। আমি বললাম চাচা আমার ফোন নাম্বার রাখলেন কেন? তিনি বলেন, ‘‘তোমার লগে কতা কইয়া আমার ভালা লাগছে, আমি এই জিনিসের আসল মালিক পাওনের লাইগ্গা মাইকে ঘোষণা দিয়াম, আসল মালিক বাইর অইলে তোমারে ছাড়া হিরত দিতাম না।” Fojlu - 02 (2)

যা হোক, আমার খুব কৌতুহল জাগছে আমাদের এই কঠিন দুনিয়ায় এখনো এমন মানুষ আছে? বুকে হাত দিয়ে কি বলতে পারি আমরা নিষ্ঠাবান? রাতের খাবার খেয়ে ঘুমোতে যাওয়ার সময় একটা অপরিচিত নাম্বারে কল আসলো। দ্বিতীয়বারের মতো কল ধরতেই আমাকে খুব বিনয়ের সহিত সালাম দিয়ে তিনি বললেন, “চাচা আমি হজলু মিয়া, কেমত আছইন? কাইল সহালে আপনে আমরার বাড়িত আইবাইন? টেহার বেগ আর মোবাইলের মালিক বাইরঅইছে।” পরদিন সকালে আমি নেত্রকোনা যাওয়ার পথে চাচার বাড়ি গিয়ে দেখি এক ঔষধ কোম্পানির ময়মনসিংহ অঞ্চলের কর্মকর্তা মটর সাইকেলযোগে তাঁর বাসায় এসেছেন। আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে এসে ওই নির্বাচন এলাকায় এগুলো খোয়া গেছে। স্থানীয় লোকজন নিয়ে শত বলার পরেও ফজলু মিয়া আমাকে ছাড়া মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ তাঁর হাতে দেননি। যথারীতি আমি তাঁর বাড়িতে যেতেই আলোচনার মাধ্যমে হারানো জিনিসগুলো ফিরিয়ে দেন ফজলু মিয়া। সকলের সামনে সেই ভদ্রলোক তাকে দু’হাজার টাকা দিতে চাইলেন। ফজলু মিয়াকে অত্যন্ত বিনয়ীভাবে বললেন, “আন্নেরা আমার লাগিন দোয়া করবাইন, টেহা দিয়া কিতা অইবো, আমি খুব বালা আছি, আমার খুব ইচ্ছা আছিল হুলিশ অহিসার অইতাম, অইছিনা তো কিতা অইছে, সরহারী সব কামেই তো ডেউটি করতাছি, অহিসার অইলে দেহাইতাম সততা কারে কয়, দেশটারে ভালাবাইস্সা সোনার বাংলাই বানাইলাম।”

এটি একটি ঘটনা। এমন হাজারো ঘটনা আমাদের দেশে ফজলু মিয়ারা সৃষ্টি করে। কিন্তু সমাজে এক শ্রেণীর মানুষ অসততাকেই জীবনের পাথেয় করে চলে। এর বিপরীতে সৎ, নিষ্ঠাবান ও দায়িত্ববোধের এক জ্বলন্ত উদাহরণ ফজলু মিয়া। বর্তমান ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থাকে হার মানিয়ে ফজলু মিয়ার সততা, নৈতিকতা, দেশপ্রেম আমাদের উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করে। সফল ও দায়িত্ববান হিসেবে উপজেলা প্রশাসন থেকে বিভিন্ন কাজে বয়স পার হওয়া সত্বেও বারবার ফজলু মিয়ার ‘ডাক’ পড়ে। কিন্তু এই কাজ করে তার সংসার চলতে চায় না। অভাব তাকে আকঁড়ে ধরে থাকে। কিন্তু সততার প্রশ্নে তিনি কখনও কোনকিছু সাথে আপোষ করেননি। তাইতো তিনি গ্রামের ঢ়েকি ছাটা চাল বাজারে বিক্রি করে তার সংসারের খরচ মেটানোর চেষ্টা করে যান কিন্তু কোনভাবেই অন্যের মূখাপেক্ষি হতে চাননা।

সৎ ও নিষ্ঠাবান হওয়ার জন্য কোন প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন নিজের ইচ্ছা শক্তির। আমরা যদি আমাদের বিবেককে জাগিয়ে তুলতে পারি তাহলে এই দেশ-এই পৃথিবী নিমিষেই হবে শান্তিময়। থাকবে না কোন বিভেদ, হিংসা-বিদ্ধেষ, কলুষতা। সকলের উচিত ফজলু মিয়ার আদর্শকে স্যালুট করা। ফজলু মিয়া বেঁচে থাক তার কাজের মধ্য দিয়ে।

happy wheels 2

Comments