নিজেদের পরিবর্তনেই হবে গ্রামের পরিবর্তন
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
স্থানীয় জাতের ধান চাষ এবং জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদের পরিমাণ বৃদ্ধি করার উদ্যেশ্য নিয়ে লক্ষীগঞ্জ ইউনিয়নের আতকাপাড়া গ্রামে ‘আতকাপাড়া কৃষাণ পাঠাগার’ নামে একটি কৃষক সংগঠন গড়ে উঠে। এই সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ৩০জন। তাঁরা প্রত্যেকেই কৃষক এবং চাষের জন্য নিজেদের জমি রয়েছে। বাজারে প্যাকেটজাত বীজের দাপট, স্থানীয় জাতের সব্জি/ধান কমে যাওযা, জমির গুণাগুণ নষ্ট হয়ে উৎপাদন কমে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যাগুলো সমাধানের জন্যই তাঁরা একত্রিত হয়েছিলেন।
চাষাবাদ সবাই করতেন, যার যতটুকু জমি আছে সেখানেই ধান ও অন্যান্য ফসল চাষ করছিলেন। কিন্তু হাইব্রিড ও উফশি জাতের ফসল চাষে তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছিলেন। তাই সকলে চিন্তা করলেন পরিবারে খাবারের জন্য যতটুকু ফসলের প্রয়োজন হয়ে অন্তত ততটুকু স্থানীয় জাতের ফসল চাষ করবেন।
এই চিন্তা থেকেই কৃষকগণ স্থানীয় জাতের ধানের বীজ সংগ্রহের কথা চিন্তা করেন। এর ফলস্বরুপ তাঁরা বারসিক’র ধানজাত গবেষণার মাঠ দিবসে অংশগ্রহণ করেন। সেখান থেকে ২ জন কৃষক জেসমিন ও সুবাশ নামক দুইটি ধানজাত সংগ্রহ করেন এবং পরবর্তী বছর নিজেদের জমিতে চাষ করেন। এভাবেই শুরু হয় তাঁদের স্থানীয় জাতের ধান চাষ। এখন জেসমিন ধানটি ৫ জন কৃষক চাষ করছেন। আর সুবাশ ধানটি ২জন কৃষক। বীজ সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রেও তাঁরা সমস্যাগ্রস্ত ছিলেন। তাঁরা যে ধান চাষ করতেন বিশেষ করে উফশি ও স্থানীয় জাত, সেসকল ধানের বীজ সংরক্ষণ করলেও শতভাগ অঙ্কুরোদগম হতোনা। তাই একজন অভিজ্ঞ কৃষকের সহযোগিতায় তাঁদের বীজ সংরক্ষণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ কর্মশালায় সহযোগিতা করা হয়। এবছর ৭ জন কৃষক সঠিকভাবে বীজের অঙ্কুরোদগমের মাধ্যমে ধান চাষ করতে সক্ষম হয়েছেন।
মাসিক সভা, গ্রামসভা, ব্যক্তিগত আলোচনার মাধ্যমে সব্জি চাষের বিষয়ে বিভিন্ন পরামর্শমূলক আলোচনা করা হয়। সংগঠনের প্রায় প্রত্যেক সদস্যই নিজের জমিতে, আঙিনায় বিভিন্ন মৌসুমে সব্জি চাষ করেন। এখন এর পরিমাণ আরো বৃদ্ধি করেছেন এবং বীজ সংরক্ষণ করতে শুরু করেছেন। তাছাড়া সব্জির পাশাপাশি বাড়ির আঙিনা বা পতিত জায়গায় বিভিন্ন মসলা যেমন আদা, হলুদ, মরিচ ইত্যাদিও চাষ করছেন।
জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ করার উদ্যেশ্যে সংগঠনের একজন কৃষক কেঁচো কম্পোস্ট তৈরি করছেন। এছাড়াও ধীরে ধীরে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমাতে শুরু করেছেন। সরকারি সেবা পরিসেবা আদায়ের ক্ষেত্রেও সদস্যরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। চলতি বছর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে সহযোগিতা হিসেবে প্রদেয় সরিষা বীজ পেয়েছেন সংগঠনের ৮ জন সদস্য। তাঁরা নদীর চরে ও নিজেদের জমিতে এই সরিষার চাষ করেছেন।
করোনাকালীন সময়ে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে গ্রামের নি¤œ আয়ের ২৫ জন কৃষক, ২ জন ভিন্নভাবে সক্ষম ব্যক্তিকে বিভিন্ন উপকরণ সহযোগিতা পেতে সাহায্য করেন। এছাড়াও গ্রামের একজন প্রবীণ কুটির শিল্পীকে উপকরণ সামগ্রী দিয়ে সহযোগিতা করেন।
গ্রামের অন্যান্য কৃষকদের বৈচিত্র্যময় চাষাবাদে আগ্রহী করতে নিজেদের উৎপাদিত পণ্য প্রদর্শন বা মেলার আয়োজন করেন। এছাড়া বিভিন্ন মৌসুমে ধান ফসলের মাঠ দিবসের আয়োজন করে নিজেদের মধ্যে বীজ বিনিময় করেন। নিজেদের সমস্যা ও সমাধানের বিষয়ে একে অপরের সাথে সহভাগিতা করেন।
এভাবেই ২০১৯ সাল থেকে কৃষাণ পাঠাগারের যাত্রা শুরু হয়। নিজেদের পারিপাশির্^ক পরিবেশ, কৃষি, ফসলবৈচিত্র্য রক্ষায় তাঁরা বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করতে শুরু করেছেন। আগামী দিনে শুধু নিজেরাই নয়, সমস্ত গ্রাম ভাসবে পরিবর্তনের জোয়ারে। এমনটাই তাঁরা স্বপ্ন দেখেন।