কৃষক মদন কুমারের প্রাকৃতিক সম্পদনির্ভর জীবন চর্চার গল্প
মানিকগঞ্জ থেকে শিমুল বিশ্বাস, রাশেদা আক্তার, বিউটি সরকার, রিনা সিকদার ও অনন্যা আক্তার
পাখির ডাকে ঘুম ভাংগে কৃষক মদন কুমারের। মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর উপজেলার আটকড়িয়া গ্রামের ৫৮ বছর বয়সী কৃষক মদন কুমার। প্রাণ ও প্রকৃতির সম্পদের নির্ভরতায় গড়ে তুলেছেন এক নান্দনিক পারিবারিক জীবনাচরণ। প্রয়োজন এবং প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা থেকেই ৩৫ শতাংশের নিজ বাড়িটিকে সাজিয়েছেন প্রাকৃতিক সম্পদের স্নিগ্ধতায়।
সকাল বেলা চড়ুই পাখির মেলা বসে তার আংগিনায়। দিনব্যাপি আলাপচারিতায় বাড়িকে মুখরিত করে রাখে শালিক এবং সাতভাই ছাতারে পাখির দল। ফুলে ফুলে প্রজাপতি আনাগোগোনা। বৃক্ষ মুকুলে মধুপের গুনগুন আওয়াজ। এক অনাবিল প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্য দিয়ে প্রকৃতির সাথে পারস্পারিক আন্ত:নির্ভরশীল সখ্য জীবনযাপন করছেন কৃষক মদন কুমার।
মদন কুমার পেশায় একজন কাঠ মিস্ত্রি। তবে মিস্ত্রি কাজের পাশাপাশি বাড়ি এবং পালানি জমিতে নিজ হাতে উৎপাদন করেন বৈচিত্র্যময় শাকসবজি, ফলমূল ও অন্যান্য শস্যফসল। যা তার সংসারের অধিকাংশ খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করে। ছাত্র জীবনে “লক্ষপতি” নামে একটি বই পড়ে প্রকৃতির গাছপালা পশুপাখি কীট পতঙ্গের গুরুত্ব বুঝতে শুরু করেন মদন কুমার। তারপর থেকেই নিজের এবং পরিবারের সুস্থ সুন্দর জীবন গড়ার তাগিদে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে শুরু করেন নানা প্রজাতি ও জাতের বীজ, বৃক্ষ ও উদ্ভিদ। সাংসারিক স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনাতে একসময় প্রবাসগামী হয়েছিলেন তিনি। তবে দীর্ঘ ২৩ বছর বিদেশে থাকলেও কমেনি তার প্রকৃতির প্রতি মমতা। নিজের স্ত্রী ভায়লা রানী এবং দুই সন্তান মৃনাল ও মৃথিল মন্ডলের মনে জাগ্রত করেছেন প্রকৃতি প্রেম। বিদেশে থাকা অবস্থায় বসতবাড়ির সৌন্দর্য্য রক্ষা ও পারিবারিক পুষ্টির নিশ্চয়তা রক্ষায় সক্রিয়ভাবে ভূমিকা রেখেছেন স্ত্রী ও সন্তানেরা। পরিবেশ রক্ষার এ উদ্যোগে এখনও উৎসাহ যুগিয়ে চলেছেন মদন কুমারের ৯২ বছর বয়সী পিতা মনতোষ মন্ডল।
উল্লেখ্য যে, প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর মদন কুমারের বাড়িকে আরো প্রাণবন্ত করে তুলতে সহায়তা করে চলেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক। ২০২২ সালে বারসিক এর পরামর্শে প্রাণ ও প্রকৃতি রক্ষার পাশাপাশি তার চিন্তাচেতনায় যুক্ত হয়েছে নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টি। যে কারণে বর্তমানে প্রকৃতিনির্ভর কৃষি চর্চাসহ তার বাড়ির প্রতিটি জায়গার সর্বোত্তমভাবে ব্যবহার কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
সম্প্রতি বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একদল পর্যবেক্ষক তার বাড়িটি পরিদর্শন করে ৩৫ শতাংশ জমির সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা দেখে অভিভুত হয়ে পড়েন। ৫ সদস্যের পরিদর্শনকারী দল দিনব্যাপি পর্যবেক্ষণের ফলাফলে উল্লেখ করেন যে, বাড়িতে আম, নারিকেল, পিচফল, জাম্বুরা, ডালিম, তাল, বিলাতিগাব, সুপারি, কাঁঠাল, লিচু, পেঁপে, পেঁয়ারা, খেজুর, কদবেল, লটকন, লেবু, আতাফল, নোনাফল, কলা, করমচা, দেশীগাব, মালটা, বেল, বড়ই, চালতা, হোগ, তিজামসহ ২৭ ধরনের ১২৯টি ফলজ গাছ রয়েছে। বনজ গাছের মধ্যে রয়েছে বন নিম, শেওড়া, হিজল, মেহগনি, দেবদারু, শিশু, ইউক্যালিপ্টাস, বট, পাকুর, বাশঝাড়, জগডুমুর, ডুমুরসহ ১২ ধরনের ৩৩টি গাছ। আবার প্রাকৃতিকভাবে রোগ নিরাময় ও নির্মল পরিবেশের জন্য বাড়িতে সংরক্ষণ করছেন নিম, বাসক, তুলশি, পুদিনা, শিবজটা, পাথরকুচি, ল্যামন গ্রাস, জবা, রক্তচন্দনসহ ৯ ধরনের ১৪টি গাছ ও ৩টি ঝাড়। প্রাকৃতির বৈচিত্র্যময় রূপ মদন কুমারকে আনন্দ দেয় বলে তিনি কাগজ ফুল, সন্ধ্যামালতি, বকুল ফুল, অপরাজিতা, মাধবিলতা, টুনটুনি ফল, বেলী, জুঁই, নয়নতারা, শিউলী, চন্দ্রমল্লিকা, রঙ্গন, কাঠগোলাপ, দত্তপ্রিয়া, পুত্তলিকা, দোপাটি, কাঠ বেলী, গোলাপ, নাগচাপা, মরিচা জবাসহ ২১ ধরনের ৪৬টি সৌন্দর্য্য বর্ধক গাছ সংরক্ষণ করছেন।
অন্যদিকে শরীর সুস্থ্য রাখতে ভেষজ উদ্ভিদের উপর রয়েছে মদন কুমারের অগাধ আস্থা ও বিশ^াস। সকালে খালি পেটে কালো মেঘের রস, পেটের অসুখে থানকুনি পাতার রস, পুষ্টির ঘাটতি পূরণে কচু, ঢেকিশাক, হাচিশাক, তেলাকুচ মদন কুমারের দৈনন্দিন ব্যবহার্য্য উদ্ভিদ। নিজের প্রয়োজনের তাগিদেই তিনি এগুলোকে গুরুত্ব সহকারে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করছেন নিজ বাড়ির আঙ্গিনায় ও অব্যবহৃত জায়গায়। যে কারণে পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, পিপল, জংলাকচু, ঘাঁওপাতা, ক্যাঁচলা, জাপানি লতা, দূর্বা, তেলাকুচ, হেঁচি, কানাইলতা, ঢেঁকিশাক, সাদা কেশরজা, কালো কেশরজা, বেজিনাথ, বিশল্ল্যাকরলি, থানকুনি, বথূয়া, মানিপ্লান্ট, সোনাতুল্ল্যা ১৮ ধরনের অচাষকৃত উদ্ভিদ গোছালো ও আগোছালো অবস্থায় সংরক্ষিত রয়েছে এ বাড়িতে। এগুলো যেমন তার নিজের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম তেমনি পূরণ করে প্রতিবেশীদের চাহিদা। ফলে প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে বলে তিনি মনে করেন। নিরাপদ খাদ্যের চাহিদা পূরণে বাড়ির আঙ্গিনা, বাঁশ দিয়ে মাচা ও গাওতা পদ্ধতি চাষ করছেন লাউ, শিম, মিষ্টিকুমড়া, বেগুন, পুঁইশাক, মরিচ, ডাটা, করলা, ব্যাঙ আলু, বিলাতি সোয়াজ, দুধকচু, সাঁজনা, লালশাক ১৩ ধরনের সবজি ফসল।
একান্ত আলাপচারিতায় মদন কুমার বলেন, “নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টি চিন্তা করেই আমি বাজারের খাবার বর্জন করতে শুরু করেছি। আমার বাড়িতে খুবই সামান্য জায়গা। তারপরও আমি মাছ, মাংশ ও লবণ ছাড়া কোন খাবার বাজার থেকে ক্রয় করি না। আমার ৩৫ শতাংশের আবাদি জমিতে ধান ও সরিষা চাষ করি। এতে আমার বছর চলে যায়। আবাদি জমির অভাবে মশলা ফসল চাষ করতে পারি না।” তিনি আরো উল্লেখ করেন, “আমার বাড়ির পাশে যে খালটি দেখছেন, এ খালের পানি আমি বাড়ির গাছপালা ও কৃষি ফসলের সেচ কাজে ব্যবহার করি। খালের কচুরিপানা দিয়ে সার তৈরি করে গাছের গোড়ায় ও ফসলের জমিেিত প্রয়োগ করি। খালের ভেতরেই কচুরিপানা একত্রিত করে সেখানে লাউ গাছ রোপণ করেছি। বাড়ির রান্নার উচ্ছিষ্ট প্রক্রিয়ার ও সার তৈরি ও ব্যবহার করি। গাছের লতাপাতা দিয়ে বালাইনাশক তৈরি ও ব্যবহার করি। ফসলের পোকা দমনের জন্য জমির পাশে আমি গাদাফুলের গাছ লাগিয়েছি। বাড়ির বিভিন্ন গাছ থেকে পাই সারাবছরের জ¦ালানি। আবার বাসি ছাই দিয়ে পোঁকা দমন করি। বাড়িতে যে দুটি বাঁশঝাড় আছে সেটা একদিকে আমার বাড়ির ভাঙন রোধে সহায়তা করে অন্যদিকে সবজির মাচা, ফসলী জমির বেড়া এবং কাঁচা ঘরের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করে।”
কৃষক মদন কুমারের বাড়ি কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যা চর্চার বাস্তবচিত্র যথেষ্ট সমৃদ্ধ। তথাপি কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যা চর্চাকে আরো দৃশ্যমান করতে বাড়িটিতে বেশ কিছু বিষয় সংযুক্ত করার সুযোগ রয়েছে। যেমন-বাড়ি সংলগ্ন খালের পাড়ে পেঁয়াজ, রসুন, অরহর, ডাল, কচু, গোলআলুর চাষ। বাড়ির ছায়াযুক্ত স্থানে আদা হলুদ চাষ। মাংস ও ডিমের চাহিদা মেটাতে খালে উন্মুক্তভাবে হাঁস পালন, গোবাদি পশু পালন এবং তার গোবর দিয়ে কেঁচো সারের খামার তৈরি, গাছের ফল ও লতাপাতা দিয়ে বালাইনাশক তৈরি ও ব্যবহার, স্থানীয় জাতের সক্রিয় বীজ ভান্ডার তৈরি, কৃষি প্রতিবেশবিদ্যা চর্চার বিভিন্ন ধরনের লিখিত ডকুমেন্টসমৃদ্ধ সংরক্ষণাগার, আবাদি জমিতে শস্য পর্যায় অনুশীলন ও ধঞ্চের আবাদ ইত্যাদি। পর্যবেক্ষক দলের মতে, উপরোক্ত বিষয়গুলো সংযুক্ত করা সম্ভব হলে কৃষক মদন কুমারের বাড়িটি হতে পারে প্রকৃতিক সম্পদনির্ভর জীবন তথা কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যা চর্চার একটি গবেষণা ও ব্যবহারিক শিখনকেন্দ্র। কৃষক মদন কুমারের চর্চায় থাকা প্রাকৃতিক সম্পদরে পুনঃব্যবহার ও পারস্পারিক আন্তঃনির্ভরশীলতার সম্পর্ক প্রক্রিয়াটি দৃশ্যমান করা হলে এলাকায় কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যা চর্চা সম্প্রসারণে বড় ধরনের অবদান রাখতে পারে।