দুর্যোগের ঝুঁকি হতে রক্ষা পেতে চায় নদীর চরে বসবাসকারী মারুফা বেগম
সাতক্ষীরা থেকে ফজলুল হক
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রতিনিয়ত প্রকৃতিক দুর্যোগের জন্য আতঙ্কে থাকে উপকূলবর্তী মানুষেরা। যতই দিন যাচ্ছে প্রকৃতিক দুর্যোগের সংখাও বেড়ে যাচ্ছে। সব কিছু জেনেও উপকূলের দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ নিরুপায় হয়ে দুর্যোগের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। তেমনই একজন নারী মারুফা বেগম। শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের চুনা গ্রামের নদীর চরে দুর্যোগের সাথে যুদ্ধ করে বসবাস করছেন তিনি।
মারুফা বেগমের (৪৭) স্বামী আমিনুর মিস্ত্রী (৫৫) একজন দিনমুজুর। মারুফা বেগমের বিয়ে হয় প্রায় তের বছর বয়সে গাবুরা ইউনিয়নের ডুমুরিয়া গ্রামে। স্বামী আমিনুর মিস্ত্রীর পিতার তেমন জায়গা জমি ছিলো। তাই বাধ্য হয়ে তিনি বুড়িগোয়ালিনী চুনায় বাপের বাড়িতে থাকতেন। একটি সময়ে মারুফা বেগমের সন্তান-সন্তানাদী হয়ে গেলে বাপের বাড়িতে থাকার সমস্যা হয়। এক পর্যায়ে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সহায়তায় সরকারী জায়গা ডিসিআর কেটে পনের শতক জায়গায় নদীর চরে মাটি ভরাট করে ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও বসবাস শুরু করেন। মারুফা বেগম ও আমিনুর দাম্পতির তিনটি সন্তান একটি ছেলে মাসুম বিল্লাহ (২৬) ও দুইটি মেয়ে আম্বিয়া খাতুন (২২), মাছুরা পারভীন (২০)। মেয়ে দুইটি বিয়ে দেন প্রায় চার বছর আগে। ছেলে মাসুম বিল্লাহকে অনেক অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে এসএসসি পর্যন্ত পড়ালেখা করাতে পেরেছিলেন। বারবার প্রকৃতিক দূর্যোগে নদীর চরে বাড়ি হওয়ায় প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হয় মারুফা বেগমের পরিবার। যেন মাথা তুলে দাঁড়াতে দেয় না, দেখা দেয় আরো অভাব। সেই অভাবের তাড়নায় ছেলেটি দেন বিনা টাকায় রাজমিস্ত্রির কাজ শিখতে।
গত আগস্ট ২০২১ সালে বারসিক’র বাস্তবায়নে নেটজ (পার্টনারশিপ ফর ডেভেলপমেন্ট জাস্টিস) এর সহাযোগিতায় বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সক্ষমতা শক্তিশালীকরণ (পরিবেশ) প্রকল্পের কাজ শুরু হয় বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নে। পরবর্তীতে এলাকা সোশ্যাল ম্যাপিং করার মাধ্যমে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ মারুফা বেগমের পরিবারকে হতদরিদ্রের তালিকায় চিহ্নিত করে পরিবেশ প্রকল্পে যুক্ত করে দেন।
মারুফা বেগম দোয়েল সিএসও দলের সদস্য হওয়ার পরে সর্বপ্রথম জলবায়ু সহনশীল কৃষি চর্চা বিষয়ক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং নিয়মিত সাপ্তাহিক দলে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও নিয়মিত আলোচনার এক পর্যায়ে পাশে নদী থাকায় মাছ ধরার জন্য নৌকা ক্রয় ও হাঁস-মুরগি পালন করার সিদান্ধ গ্রহণ করেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণ পরবর্তী মারুফা বেগমকে আয়বর্ধনমূলক কর্মকান্ডের উপকরণ হিসাবে একটি নৌকা, হাঁস ও মুরগি, বীজ ও গাছের চারাসহ মোট ১৩,৫০০ টাকার সম্পদ দেওয়া হয়।
স্বামী আমিনুর মিস্ত্রী অসুস্থ (হাটুতে ব্যাথা) থাকায় ভারী কোন কাজ করতে না পারায় সংসার চালাতে খুবই কষ্ট হয়ে যেতো। সহজভাবে জীবিকা নির্বাহ করার জন্য পাশে চুনা নদীতে মাছ ধরার উপকরণ হিসাবে নৌকা ক্রয় করে সংসার চালাতে খুবই সহায়ক হয় তাঁর জন্য। আগে নৌকা না থাকায় বেশি দুরে যেতে পারতেন না এমনকি নদীর এপার থেকে ওপারে যাওয়া যেতো না। ফলে ভালো মাছও পেতেন না। বর্তমানে আগের তুলনায় আয়ও ভালো হচ্ছে। স্বামী-স্ত্রী মিলেও আয় করতে পারেন। সেই আয় দিয়ে সংসার চালানো, নিয়মিত সঞ্চয় জমা, কন্ট্রিবিউশান পরিশোধ, এসফোরআই জমা দিয়ে যাচ্ছেন মারুফা বেগম। একই সাথে আয়ের টাকা জমা করে তিনটি ছাগল ক্রয় করে, বর্তমানে সাতটি ছাগল আছে তার বাড়িতে। অন্যদিকে ছেলে মাসুম বিল্লাহ রাজমিস্ত্রির কাজটি ভালোভাবে শিখতে পেরেছেন, তিনি প্রতি মাসে প্রায় বারো হাজার টাকা আয় করছেন। বিয়েও করেছেন মাসুম বিল্লাহ।
সর্বশেষ মারুফা বেগম বলেন, ‘স্বামী অসুস্থতার সময়ে বারসিককে পাশে পেয়েছি, আগের তুলনায় এখন অনেক ভালো আছি। কিন্তু দুর্যোগের ঝ্ুঁকির মধ্যে এখনো রয়েছি। সবসময় ভয়ের মধ্যে থাকি, রাতে ভালো ঘুমও হয় না, কখন জানি প্রবল জোয়ার এসে তলিয়ে নিয়ে যায়। সে ঝুঁকির হাত থেকে বাঁচতে দুর্যোগের ঝুঁকি মুক্ত একটু জায়গা ক্রয় করে বসবাস করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’