শান্তির জন্য পানির দূষণ কমাই সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করি

সিলভানুস লামিন

এক
পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগ হচ্ছে পানি। বিশুদ্ধ পানির উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে উপরিভাগের পানি তথা নদীনালা, খাল, বিল, নালা, ডোবা, পুকুর, ঝর্ণা এবং ভূগর্ভস্থ পানি। বলা হয়, পৃথিবীর মোট পানির মাত্র ২.৫ ভাগ মিষ্টি এবং বাকি ৯৭.৫ ভাগ পানি হচ্ছে লবণাক্ত। এছাড়া মিষ্টি পানির মধ্যে মাত্র ০.০২৫ ভাগ পানি হচ্ছে পানযোগ্য। ফলে কৃষির জন্য, গৃহস্থালী কাজের জন্য, শিল্পকারখানার জন্য এবং মানুষের পানের জন্য আজ সর্বত্রই পানি সঙ্কট অনুভূত হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশেসহ বিশ্বব্যাপী বিশুদ্ধ পানির আধারগুলোর দূষণ, দখল এবং ভরাট করার প্রতিযোগিতা চলছে! পানি নিয়ে চলছে নানা বিতর্ক, দ্বন্দ্ব ও সংঘাত। বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলে বর্তমানে তীব্র পানি সঙ্কটে ভুগছেন সেখানকার বাসিন্দারা, কম যায়নি উপকূলীয় অঞ্চলের পানি সঙ্কটের চিত্র্যও! তথাকথিত ও অপরিকল্পিত উন্নয়নের শিকার হচ্ছে আমাদের দেশের বেশিরভাগ সুপেয় পানির উৎস্যগুলো। তাই তো দেখা গেছে, আমাদের দেশে বুড়িঙ্গা, ধলেশ্বরী, শীতলক্ষ্যা, সুরমা, মনু, সুমেশ্বরী নদীসহ অসংখ্য বিশুদ্ধ পানির উৎসগুলো দূষণ, ভরাট এবং দখলের কারণে ধীরে ধীরে ধবংস ও বিলুপ্ত হতে চলেছে। উপরোন্তু রাসায়নিক কৃষি, উপকূলীয় অঞ্চলে অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষের কারণে লবণাক্ততা, দেশের অসংখ্য জেলায় আর্সেনিক দূষণ, নদীর তীরবর্তী ও নদী পানিপ্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ এবং নদীর গর্ভে শিল্পকারখানার বর্জ্যসহ অন্যান্য মানবসৃষ্ট বর্জ্য নিক্ষেপের কারণে আজ বাংলাদেশে পানি সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করছে। জলবায়ু পরিবর্তন এই সঙ্কটকে আরও ঘনীভূত ও প্রকটতর করে তুলেছে। কারণ জলবায়ুজনিত পরিবর্তনের কারণে স্বল্প বৃষ্টিপাত, বৃষ্টিহীনতা এবং আকস্মিক বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংঘটিত হওয়ার ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ায় সামগ্রিকভাবেই বিশুদ্ধ পানির উৎসগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বের ৫০% জনংখ্যা সুপেয় পানি সঙ্কটাপন্ন এলাকায় বসবাস করবে। এছাড়া জাতিসংঘের জলবায়ু প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্ব উষ্ণতার কারণে হিমালয়ের বরফ গলে যাওয়ায় আগামী ২০৫০ সালে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেকং, ইন্দুস, সালয়িন নদীগুলো বিলুপ্ত হতে পারে। আমাদের দেশের মানচিত্রেও অনেক নদ ও নদী বিলুপ্ত হওয়ার প্রতিবেদন ও প্রত্যক্ষ প্রমাণ রয়েছে।

দুই
২০০০ সালে সারাবিশ্বের ১.১ বিলিয়ন মানুষ বিশুদ্ধ পানির পর্যাপ্ত প্রবেশাধিকার ছিলোনা। ২০২২ সালে এই সংখ্যা কিছুটা কমলেও সমস্যা কিন্তু এখনও কমেনি। বর্তমানে (২০২২) ৭০৩ মিলিয়ন মানুষ বিশুদ্ধ পানির প্রবেশাধিকার নেই। অর্থ্যাৎ বিশ্বের প্রতি ১০ জন থেকে ১ জন মানুষ বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছে না। বিশুদ্ধ পানির প্রাপ্তিতে সমস্যার কারণে সারাবিশ্বে প্রতিদিন ৫ বছরের নীচে ১০০০ জন শিশু মারা যায়। পানি সঙ্কট মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করেছে। তাই তো দেখা গেছে, সারাবিশ্বে প্রতিবছর প্রায় এক মিলিয়ন মানুষ মারা যায় পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে। বিশুদ্ধ পানি না পাওয়ায় এসব মানুষ দূষিত পানি পান করতে বাধ্য হয়েছেন। অন্যদিকে, বিশ্বে পানি সঙ্কটের গভীর প্রভাব পড়েছে নারীর ওপর। কারণ সুপেয় পানি আহরণের জন্য গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি নারীকে দৈনিক কয়েক ঘণ্টা ব্যয় করতে হয়। এছাড়া দূষিত পানি পানের কারণে কিংবা গৃহস্থালি কাজে ব্যবহারের কারণে নারীরা নানান পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। পানি সংগ্রহ করার জন্য সারাবিশ্বে নারী ও মেয়েরা প্রতিদিন ২০০ মিলিয়ন ঘণ্টা সময় ব্যয় করেন। অথচ, পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত হলে কিংবা বিশুদ্ধ পানির উৎস্যগুলো দূষিত না হলে বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহে নারী ও মেয়েরা যে সময়টা ব্যয় করেছেন সেটা অর্থনৈতিক কাজে ব্যয় করা যেতো। বলা হয়, বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশনের অভাবের কারণে প্রতিবছর সারাবিশ্বে ২৬০ বিলিয়ন ডলার অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। মূলত দরিদ্ররাই এসব পানি সঙ্কটের নেতিবাচক প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেশি। এ মানুষগুলোই পানিবাহিত নানান রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবছর তাদের মৃত্যুর হার বেশি এবং পানিকেন্দ্রিক যত ধরনের সমস্যা তারাই বেশি সন্মূখীন হচ্ছে।

তিন
পানি সঙ্কটের মূলে অনেকে পানি সম্পদের বা আধারের স্বল্পতার পাশাপাশি পানি অব্যবস্থাপনাকেও দায়ি করেছেন। সুপেয় পানি সম্পদের উৎসগুলোকে দূষণ করার কারণে পানি সমস্যা সৃষ্টি করছে তা সত্য; তবে পানি সম্পদের অপ্রতুলতা বা জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণেই যে বিশ্বব্যাপী সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে তা কিন্তু নয় বরং অনেকের মতে, পানি অব্যবস্থানাই এই সঙ্কটের অন্যতম মূল কারণ। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের ১২% মানুষ ৮৫% ভাগ সুপেয় পানি ব্যবহার করে এবং ১২% মানুষ কিন্তু তৃতীয় বিশ্বে বাস করে না। পানি সঙ্কটের মূল কারণই হচ্ছে ক্ষমতা, দারিদ্র্যতা ও অসাম্যতা! উন্নয়নশীল এবং তৃতীয় বিশ্বের মানুষেরাই সবচে’ বেশি পানি সঙ্কটে ভুগলেও কোকাকোলার মতো বহুজাতিক কোম্পানির পানীয় উৎপাদনের জন্য তৃতীয় বিশ্ব বা উন্নয়নশীল দেশের পানি সম্পদ ব্যবহার করে। তাই তৃতীয় বিশ্ব ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সুপেয় পানি সঙ্কট মোকাবিলায় সুপেয় পানির উৎস রক্ষার পাশাপাশি সুষ্ঠু পানিব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। সুপেয় পানি সঙ্কট নিরসন ও পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার জন্য জাতিসংঘ এসডিজির মাধ্যমে সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে নানান উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছে। এসডিজির ৬নং লক্ষ্যটিই হচ্ছে বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশন। বাংলাদেশসহ সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য জাতিসংঘ নানাভাবে তাগিদ দিয়ে আসছে। কারণ ২০৩০ সালের মধ্যেই এ লক্ষ্য অর্জন করতে হবে।

চার
এ বছর (২০২৪) পানি দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে পানি ও শান্তি (Water for Peace) বা শান্তির জন্য পানি। পানি সঙ্কট পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নানান সমস্যা তৈরি করে। পানি সঙ্কটের কারণে কৃষি উৎপাদনসহ নানান অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ব্যাহত হয়; দারিদ্র্যতার হার বৃদ্ধি পায়। পানি সঙ্কট স্বাস্থ্য খাতেও নানান সমস্যা তৈরি করে। অল্প বয়সে অনেক মানুষ মারা যায়; স্বাস্থ্য চিকিৎসায় অনেকে নিঃস্ব হয়ে যায়, যা পরিবারের শান্তিকে বিঘ্নিত করে। তবে সুপেয় পানির প্রাপ্তি হলে কিংবা বিশুদ্ধ পানিতে অভিগম্যতা থাকলে নানান পানিবাহিত রোগ প্রতিরোধ করা যায়; শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হারও কমে যায়। অন্যদিকে বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহের জন্য যে সময়টা ব্যয় হয় সেটা উৎপাদন ও অর্থনৈতিক কাজে ব্যবহার করা যায়, যা দারিদ্রতা দূরীকরণে ভূমিকা রাখে। এছাড়া, সুপেয় পানির প্রবেশাধিকার থাকলে মেয়ে শিশুদের স্কুলে যাওয়ার হার বেড়ে যায় সুপেয় পানি সংগ্রহে যেতে হয় না বলে! শান্তির পূর্বশর্ত হচ্ছেই, সুস্থ ও স্বচ্ছল থাকা। সুপেয় পানির সঙ্কট মানুষের স্বাস্থ্যহানি করে এবং তাদের অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে ব্যাহত করার মধ্য দিয়ে দরিদ্র করে তোলে। একটি পরিবারের সদস্যরা যদি দারিদ্রে নিমজ্জিত না হয় এবং তারা যদি সুস্থ ও সবল থাকেন তাহলে বলা যায়, তারা শান্তিতে ও সমৃদ্ধিতে বসবাস করতে পারেন। তাই শান্তির জন্য সুপেয় পানির প্রবেশাধিকার অবশ্যই একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত। তাই আসুন পানি দূষণ করে এমন কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকি এবং সুপেয় পানির কার্যকর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার জন্য নানান উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সরকারকে চাপ দিই।

happy wheels 2

Comments