কৃষক নজরুল ইসলামের ধান বীজ শোধন প্রক্রিয়া
বুড়িগোয়ালিনি, শ্যামনগর থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল::
কৃষির মূলভিত্তি হলো বীজ। বীজই হচ্ছে কৃষির প্রাণ। সুস্থ ও বীজ ভালো ফসল উৎপাদনের নিয়ামক। তাই ভালো ফলন পাওয়াসহ ফসলের সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য ভালো বীজের কোন বিকল্প নেই। স্বাভাবিকভাবেই কৃষকরা তাদের লোকায়ত জ্ঞান ব্যবহার করে জমি থেকে বীজ সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও শোধনে খুবই আন্তরিক থাকেন, থাকেন সচেতন। ভালো ও মানসম্পন্ন বীজ সংরক্ষণ করার দিকে তাদের মনোযোগ বেশি। একসময় কৃষকেরা মাঠ থেকে পরিপক্ক, সুস্থ, সবল ফসল থেকে বীজ সংগ্রহ, সংরক্ষণ করতেন। তবে আধুনিক কৃষির আগমনের পর থেকে কৃষকদের এই চর্চা কিছুটা হলেও ব্যাহত হচ্ছে। বেশি উৎপাদনের লোভ দেখিয়ে তাদেরকে বাজারের বীজের ওপর নির্ভরশীল করে তোলা হয়েছে। ফলে কৃষকের ঐতিহ্যবাহী বীজ সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং শোধনের যে লোকায়ত চর্চা ও সংস্কৃতি একসময় বিদ্যমান ছিলো সেটি আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হতে শুরু করেছে। তবে গ্রামবাংলার এখনও এমন কৃষক রয়েছেন যারা আধুনিক কৃষির প্রচারণা ও প্রলোভনকে এড়িয়ে চলে নিজের মতো করে এখনও কৃষি চর্চা করছেন। এখনও ফসল উৎপাদন করছেন, নিশ্চিত করছেন পারিবারিক খাদ্যনিরাপত্তা ও পরিবেশের ভারসাম্য। এসব কৃষকেরা মাঠে ভালো ফসল উৎপাদনের জন্য, চাষকৃত ফসলে পোকামাকড় ও রোগের আক্রমণ হ্রাস করার জন্য মানসম্মত ও সুস্থ ফসল থেকে বীজ সংগ্রহ করেন এখনও। সংগৃহীত বীজ পরের মৌসুমে চাষবাদের জন্য তারা শোধন প্রক্রিয়াটি খুব আন্তরিকভাবে করেন।
সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার ইসমাইলপুর গ্রামের চাষী নজরুল ইসলাম হচ্ছেন এমনই একজন কৃষক যিনি এখনও লোকায়ত জ্ঞানভিত্তিক স্থায়িত্বশীল কৃষি চর্চা করে নিজের পরিবারের খাদ্যনিরাপত্তা ও পরিবেশ সংরক্ষণে ভূমিকা পালন করে আসছেন। দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ায় ছোটবেলা থেকে বাবার সাথে কৃষি পেশার সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি। বাবার কাছ থেকে শিখেছেন কৃষি সংশ্লিষ্ট সব ধরনের কাজ। মাঠে ভালো ফসল উৎপাদনের জন্য সুস্থ ও মানসম্মত বীজের কোন বিকল্প নেই সেই বিষয়টি তিনি তার বাবার কাছ থেকে শিখেছেন। তিনি তার মাঠের পরিপক্ক, সুস্থ, সবল ফসল থেকে বীজ সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করেন পরবর্তী মৌসুমে চাষবাস করার জন্য। ভালো ফলানোর জন্য বীজ শুধু সংরক্ষণ করলেই হয় না, চাষবাসের আগে সেই বীজগুলোর শোধন প্রক্রিয়া সমান গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি জানিয়েছেন। এসব বীজ শোধনে নিজস্ব একটি পদ্ধতি রয়েছে বলে তিনি জানান। তাই আগ্রহ ভরে কৃষক নজরুল ইসলামের কাছে তার ধান বীজ শোধন প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ভালো সন্তানের জন্য যেমন ভালো পিতামাতার দরকার হয়, ঠিক তেমনি ভালো ফলনের জন্য ভালো বীজের দরকার হয়। বীজ সংগ্রহ, সংরক্ষণ যেমন একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তেমনি এই বীজের শোধন প্রক্রিয়াটি খুব সতর্কতার সাথে করতে হয় ভালো ফলন পাওয়ার জন্য।” তিনি বলেন, বীজতলার ধান ভেজানোর আগে বীজ শোধন করার ক্ষেত্রে আমি প্রথমে একটি পাত্রে ১২ লিটার পানি রেখে সে পানির মধ্যে এক কেজি লবণ মিশিয়ে তার মধ্যে একটি ডিম ছেড়ে দিই। ডিমটি লম্বালম্বিভাবে পানির মধ্যে ভাসলে বুঝতে বুঝতে পারি যে পানি সঠিকভাবে মিশ্রিত হয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “এই মিশ্রিত পানির মধ্যে ৫ কেজি ধান আধা ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখি। ভিজিয়ে রাখার ফলে স্বাভাবিকভাবে চিটা ধানগুলো উপরে উঠে আসে এবং সেগুলো তুলে ফেলে দিই।” তিনি বলেন, “ভেজানো ধান নেটের মধ্যে রেখে ৫ মিনিট ঝুলিয়ে রাখি পানি ঝরিয়ে নেওয়ার জন্য। এরপর ১০০টি জামের পাতা থেতো করে নিয়ে রস বের করে ছেকে নিয়ে বীজগুলো পুনরায় ১২ লিটার পানির মধ্যে মিশিয়ে নিই। এভাবে বীজগুলো আধা ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখি। আধা ঘণ্টার পর পানি সরিয়ে নিই। আমি মূলত এভাবে ধান বীজ শোধন করি। বীজ শোধন করার পর তা “জাক” দিই এবং ভেজানোর পরে “ওম” দিয়ে অংকুরোদগম হলে তা বীজতলায় ফেলি।” তিনি বলেন, এভাবে বীজশোধন করার ফলে বীজ জীবাণুমুক্ত হবে এবং ধান গাছ রোগমুক্ত হবে”।
কৃষক নজরুল ইসলামের মতো গ্রামবাংলার অনেক কৃষক রয়েছেন যারা কৃষি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় এখনও তাদের লোকায়ত জ্ঞান ব্যবহার করে বৈচিত্র্যময় শস্য ফসলের উৎপাদন করে আসছেন। সাতক্ষীরা জেলাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার অনেক কৃষক পূর্বে এভাবেই কৃষিচর্চা করতেন। তাদের জীবন-জীবিকা ছিল সম্পূর্ণভাবে কৃষিনির্ভর। তারা ফসল পঞ্জিকা অনুসারে জমির ধরন ও মৌসুমভিত্তিক স্থানীয় ফসল চাষাবাদ করতেন। প্রতিটি ফসল থেকে তারা বীজ সংরক্ষণ ও পারস্পরিক আদান প্রদানের মাধ্যমে গড়ে তুলেছিল নিজস্ব বীজভান্ডার। ধান ছাড়াও তারা মৌসুম ও জমির ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন স্থানীয় প্রজাতির নানান জাতের ডাল, পাট, সরিষা, তিল, গম, ধান, মসলা ও সবজি আবাদ করতেন। কৃষি উপকরণ তথা বীজ, সার সবকিছুই তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিলো। তারা স্বাবলম্বীও ছিলেন। তবে সাতক্ষীরা জেলায় ১৯৮০ দশকে লবণ পানি এনে চিংড়ি চাষ, কৃষিজমি অকৃষি খাতে ব্যবহার, অপরিকল্পিত উন্নয়ন অবকাঠামো নির্মাণ এবং বিশেষ করে আধুনিক কৃষির সূচনা হলে কৃষকের সেই চিরচেনা লোকায়ত কৃষি চর্চা বাধাগ্রস্ত হয়। আধুনিক কৃষির কর্তাদের প্রলোভনে পড়ে কৃষকেরা তাদের চিরচেনা ঐতিহ্যবাহী লোকায়ত কৃষি চর্চা ছেড়ে কোম্পানির বীজ, সারসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ফলে ধান বীজ শোধনসহ অন্যান্য পরিবেশবান্ধব লোকায়ত কৃষি চর্চাগুলো বিলুপ্ত হতে শুরু করে। তবে কৃষক নজরুল ইসলামসহ ইসমাইলপুর গ্রামের অন্যান্য কৃষকরা স্থায়িত্বশীল কৃষি চর্চায় এগিয়ে আসছে। তাদের গ্রামে ও আশপাশের গ্রামগুলোতে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন কৃষক সংগঠন। এই সংগঠনের মাধ্যমে কৃষকেরা তাদের সেই চিরচেনা ঐতিহ্যবাহী লোকায়ত কৃষির ফিরিয়ে আনার জন্য নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বারসিক এসব কৃষক ও কৃষক সংগঠনগুলো নানাভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। কৃষক নজরুল ইসলামের মতো অন্যান্য সফল কৃষকদের বিষয়গুলো বিভিন্নভাবে প্রচার ও প্রসারের জন্য বারসিক কাজ করে যাচ্ছে। যাতে এই কৃষকদের সাফল্যে কৃষকরা অনুপ্রাণীত হয়ে আধুনিক কৃষির আগ্রাসন থেকে নিজেদের মুক্ত করে কৃষি সংশ্লিষ্ট সব ধরনের প্রক্রিয়ায় তাদের অধিকার ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। কারণ কৃষির সামগ্রিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন কৃষককে সহযোগিতা ও সক্ষম করে গড়ে তোলা। কৃষি তাদের কাছে একটি লাভজনক খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। কৃষি উপকরণের জন্য তারা যাতে অন্যের ওপর নির্ভরশীল না হয় সে বিষয়টির দিকে দৃষ্টি দেওয়া। কৃষিতে কৃষকের অধিকার ও নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন লোকায়ত জ্ঞানভিত্তিক কৃষকের সেই অতীত স্থায়িত্বশীল কৃষিকে পুনঃপ্রবর্তন করা। এক্ষেত্রে কৃষক নজরুল ইসলামের লোকায়ত বীজ শোধন পদ্ধতিসহ অন্যান্য সফল কৃষি সংস্কৃতির তথ্য ও চর্চাগুলোকে অন্য কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে ও প্রচার করা। কৃষক নজরুল ইসলাম নিজেও তার এই চর্চা, অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান তার গ্রামের অন্যান্য কৃষকের সাথে সহভাগিতা করেন।