সবুজ জ্বালানি হিসেবে মশালের ব্যবহার
সাতক্ষীরা থেকে মননজয় মন্ডল
আমাদের জীবাশ্ম জ্বালানির মজুদ সীমিত, যা এক সময় না এক সময় ফুরিয়ে যাবে। এজন্য নিজেদের প্রয়োজনে এবং পরিস্থিতির বিচারে জ্বালানি হিসেবে বিকল্প জ্বালানিকেই আমাদের বেছে নিতে হবে। কেননা বিশ্বজুড়েই এখন শক্তির সংকট চলছে, আর এ কারণে আমাদের বিকল্প জ্বালানি হিসেবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধিতে অগ্রসর হতে হবে। এর সেক্ষেত্রে আমাদের গ্রামের নারীরা সবুজ জ্বালানি ব্যবহারে বিশেষভাবে ভুমিকা রেখে চলেছে। সবুজ জ্বালানি হিসেবে গ্রামীণ নারীরা মশাল ব্যবহার করছে।
সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগরের ধূমঘাট গ্রামের প্রতিটি পরিবারের নারীরা সবুজ জ্বালানি হিসেবে সোলার হোম সিস্টেম, সূর্যের আলো, বাতাস, পুকুর, প্রাকৃতিক জলাশয় ও বৃষ্টির পানি ব্যবহার করে। এছাড়া রান্নার জন্য বায়োমাস হিসেবে কাঠ, ঘুটে, মশাল, নাড়া, তুষ, ভুষি, খড়, কুটো, নাড়ার গোচ, গুল, শুকনো ডাল, সব ধরনের পাতা প্রভৃতি ব্যবহার করেন। এর মধ্যে জ্বালানির প্রধান উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে গোবরের তৈরি মশাল। স্থানভেদে অনেকেই এটাকে বুলেন, বড়ি, মুইঠ্যা বা লাকড়ি বলে থাকেন। এলাকায় বর্তমানে জ্বালানি সংকট মোকাবেলায় গোবরের শলার লাকড়ি তৈরি করা হচ্ছে পুরোদমে। আর গোবরের এই মশাল তৈরি করে পারিবারিক জ্বালানির চাহিদা মেটানোর পর বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন পরিবারের অনেক গ্রামীণ গৃহিণীরা। মশাল এমন ধরনের জ্বালানি যা তৈরি করা খুবই সহজ। খরচও কম এবং পরিবেশের কোন ক্ষতি করে না। পরিবেশ সহায়ক এ জ্বালানি তৈরিতে উপকরণ হিসেবে প্রয়োজন গরু বা মহিষের গোবর, পাটখড়ি বা কাঠি, ধানের তুষ (কুড়া)ও পরিমাণ মতো পানি। গ্রামীণ নারীদের লোকায়ত জ্ঞান ও পদ্ধতি ব্যবহার করে মশাল তৈরি করে। মশাল তৈরির আগে পরিমাণ মতো পাটখড়ি কেটে গোবর ও তুষ (কুড়া) একত্রে মিশিয়ে পাটখড়ির সঙ্গে এঁেট রোদে শুকাতে হয়। এছাড়াও মুঠো করে ঘষি বানিয়ে রোদে শুকিয়েও ব্যবহার করেন অনেক পরিবার। বর্তমানে জ্বালানি সংকট ও এর দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন গ্রাম ছাড়াও শহরে এই মশালের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। সব শ্রেণীর মানুষ এই মশাল স্বল্পমূল্যে কিনে জ্বালানি হিসেবে রান্নার কাজে ব্যবহার করছে।
এলাকায় অধিকাংশ বাড়িতে গরু থাকায় মশাল তৈরি করতে অসুবিধা হয় না ধূমঘাট জনপদের গৃহিনীদের। যাদের গরু নেই তারা বিল থেকে গোবর সংগ্রহ বা অন্যের বাড়ি থেকে গোবর কিনে এনে মশাল তৈরি করে। আর এই মশাল রান্নার কাজে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করার জন্য ঘরের মধ্যে সংরক্ষণ করে রাখা হয় প্রয়োজন মুহুর্তে ব্যবহারের জন্য। বিশেষ করে বর্ষাকালে প্রতিটি পরিবারে অন্যান্য জ্বালানির পাশাপাশি মশালের ব্যবহার দেখা যায়। বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষিপদক প্রাপ্ত কৃষাণী অল্পনা রাণী, কৃষাণী পারুল বালা ও বিরতী রাণী মশাল জ্বালানী সম্পর্কে জানান, তাদের এলাকায় আগে প্রচুর পরিমাণে গাছপালা ছিল, দেশী ধান ছিল, বন জঙ্গল ছিল, সহজে জ্বালানির উপকরণ পাওয়া যেত। এখন জ্বালানির সংকট দেখা দিচ্ছে, কেননা আগের মত গাছপালা, বন-জঙ্গল নেই। তাই তারা গোবর থেকে ঘুটে বিশেষ করে মশাল তৈরি করেন। এটা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায় সহজে। এবং এটার ছাই পরবর্তীতে জৈব সার হিসেবে ফসলের ক্ষেতে ব্যবহার করা যায়।
জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারে বায়ুমন্ডলের গ্রীণ হাউস গ্যাসের পরিমাণ ক্রমাগত বাড়ছে। ফলে হুমকির মুখে পড়ছে পরিবেশ। প্রচলিত জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে বিকল্প জ্বালানি/নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করলে বায়ুমন্ডলে গ্রীণ হাউস গ্যাস (যেমন-কার্বন-ডাই অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, মিথেন, ওজোন) এর পরিমাণ কমে আসবে। ফলে পরিবেশ দূষণ অনেকটাই কমে যাবে। তাই আমাদের বিকল্প জ্বালানি হিসেবে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য ব্যক্তি, দল ও রাষ্ট্রীয়ভাবে ভূমিকা পালন করতে হবে।
গ্রামীণ নারীরদের সুদীর্ঘকালের একটি লোকায়ত চর্চা রান্নার জন্য জ্বালানি উপকরণ হিসেবে মশাল তৈরি। পরিবেশবান্ধব এ জ্বালানি ব্যবহারে একদিকে যেমন জ্বালানি ব্যয় সাশ্রয় হচ্ছে অপরদিকে তেমন জ্বালানি সংকট নিরসন ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে।