নারী জাগরণের এক দৃষ্টান্তের নাম নাজমুননাহার
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল ও রামকৃষ্ণ জোয়ারদার
দোষে-গুণে মানুষ। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় নারী সমাজ অবহেলিত, নির্যাতিত। সামাজিক শৃঙ্খলের বেড়াজালে নারী সমাজ আবদ্ধ। সামাজিক শৃঙ্খলার বেড়ি থেকে অবহেলিত নারী সমাজকে মুক্ত করে উন্নয়নশীল সমাজ ব্যবস্থায় নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা ও নারীর ক্ষমতায়নে আবির্ভূত হয়েছেন বেগম রোকেয়া, প্রীতিলতা ওয়াদেদ্দার প্রমুখ নারী নেতৃত্বের। তাদের গড়ে তোলা সামাজিক উন্নয়ন আন্দোলনের সফল নেতৃত্বদানে পরিবর্তনশীল সময়ের ব্যবধানে প্রান্তিক পর্যায়েও অবদান রাখছেন সমাজের প্রান্তিক নারীরা।
তেমনি একজন নারী সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার ৫নং কৈখালী ইউনিয়নের জয়াখালী গ্রামের নাজমুননাহার ওরফে নার্গিস বেগম। ছোটবেলা থেকে নাজমুননাহার বেগম ছিলেন খুবই সাহসী ও কর্মঠ। সবসময়ই সমাজের জন্য কিছু করেন তিনি। কেউ বিপদে পড়লে এগিয়ে যাওয়া মানুষের পাশে থাকেন। পরিবার থেকে সকলে তাঁকে এ কাজে উৎসাহিত করতেন। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে এসেও মানুষের জন্য কিছু করার ইচ্ছাশক্তি কমেনি তাঁর। এক্ষেত্রে তাঁর স্বামীও তাঁকে নানাভাবে সহযোগিতা ও উৎসাহিত করেন। তাই তো দেখা গেছে, গ্রামের কোন মহিলা বিপদে পড়লে নাজমুননাহার বেগম খবর পেলে সেখানে এগিয়ে যান এবং গ্রামের মহিলাদের সাহস যোগান। গ্রামে বিভিন্ন সালিশ, ভিজিডি কার্ড, ভিজিএফ, গর্ভবতী মহিলাদের চেকআপ, ধাত্রী সেবাদানসহ বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ প্রদানের পাশাপাশি সেবা পেতে সহযোগিতা করেন।
নাজমুননাহার গ্রামের নারীদের ভেতরে সঞ্চয়ের মনোভাব গড়ে তোলার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেন। সঞ্চয় করলে কি কি উপকার হতে পারে এবং কীভাবে স্বাবলম্বী হওয়া যাবে সেই বিষয়ে তিনি নারীদের নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেন। সঞ্চয়ের পাশাপাশি নারীদের সংগঠিত করার জন্য ব্রাক এর সহযোগিতায় একটি পল্লী সমাজ করে তুলতে ভূমিকা রাখেন। পল্লী সমাজের নারীদের নিয়ে মাসিক মিটিং এর মাধ্যমে চলমান সমস্যা সমাধানে সচেতন করা হয়।
এ কাজের মধ্য দিয়ে তিনি গ্রামে ও সমাজে অনেক পরিচিতি লাভ করেন। আর এ পরিচিতির মধ্যে থেকে গ্রামীণ নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি নিজ গ্রাম ২০০৮ সালে জয়াখালী নারী সংগঠন তৈরি করেন। বর্তমানে এ সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ৪৫২ জন। এই সংগঠন গড়ে তোলার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে নাজমুন্নাহার জানান, সংগঠন গড়ে তোলার মূল উদ্দেশ্য ছিলো সমাজ থেকে বাল্যবিবাহ বন্ধ করা, পারিবারিক বিরোধ নিরসনে সহযোগিতা করা, হতদরিদ্র নারীদের সেবা আদায়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করা অন্যতম। এছাড়াও এই সংগঠনের মাধ্যমে যাতে ইউনিয়ন পরিষদের স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য হওয়া যায়, প্রতিবন্ধী মানুষ চিহ্নিত করে তাদের বিভিন্ন সেবা পাইয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করা এবং নারীদের সঞ্চয় কাজে উদ্ধুদ্ধ করাও অন্যতম উদ্দেশ্য ছিলো।
বর্তমানে এই সংগঠনের সদস্যরা তাদের উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য নানাভাবে কাজ করে যাচ্ছেন নাজমুন্নাহারের নেতৃত্বে। মূলত নাজমুন্নাহারের নেতৃত্বে ২০১২ সাল থেকে কৈখালী ইউনিয়নের তারানীপুর গ্রামের তারানীপুর নারী সংগঠন, বৈশ্যখালী গ্রামে বৈশ্যখালী নারী সংগঠন ও দক্ষিণ বৈশ্যখালী নারী সংগঠন, মানিকখালী গ্রামে মানিকখালী নারী সংগঠন, পশ্চিম কৈখালী গ্রামে পশ্চিম কৈখালী নারী সংগঠন তৈরি হয়েছে। এ সংগঠনগুলোতে বর্তমান সদস্য সংখ্যা প্রায় ৮০০ জন। বিভিন্ন গ্রামে নারীদের স্বতন্ত্র সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা ও ভূমিকা রাখার কারণে নাজমুন্নাহার এলাকায় জনপ্রিয় নারী নেত্রী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। একটা সময় ছিলো যখন এসব কাজের জন্য তাকে গ্রামে ঘুরতে হতো। কিন্তু বর্তমানে মানুষ কোন সমস্যায় পড়লে তা সমাধানে সবাই তাঁর বাড়িতে আসেন পরামর্শ ও সহযোগিতা নিতে।
নাজমুননাহার বেগম চান আজীবন অসহায় ও নিপীড়িত মানুষের পাশে থেকে তাদেরকে সেবা করার। তিনি মনে করেন এই সেবা ও উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমেই গ্রামীণ মানুষ সচেতন হবে, নিজেদের দক্ষ ও যোগ্য করে তুলবে। এভাবে তারা নিজেরাই তাদের অধিকার আদায় করতে পারবে।