সঞ্জিত কুমার মনিদাস: একজন স্বপ্নবাজ তরুণের গল্প
মানিকগঞ্জ থেকে নীলিমা দাস
সংগ্রামী জীবন
লেখাপড়ার অদম্য আগ্রহ ছিল ছোটবেলা থেকে। যদিও পরিবার, বংশ কিংবা মনিদাস সম্প্রদায়ে বেশিদূর পড়ালেখার চল নেই। মানিকগঞ্জ জেলার বেতিলা ইউনিয়ন এর বড় বড়িয়াল গ্রামের বাসিন্দা সঞ্জিত কুমার (১৯)। পরিবারের আর্থিক অস্বচ্ছলতার সাথে সংগ্রাম করে এসএসসি. পাশ করে স্থানীয় স্কুল এবং কলেজ থেকে। কিন্তু তার প্রকৃত সংগ্রামী জীবন শুরু হয় পর থেকে। সঞ্জিত টাঙ্গাইল টেকনিক্যাল কলেজে ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে ডিপ্লোমা প্রকৌশলী হিসেবে লেখাপড়ার সুযোগ পায়। কিন্তু, দারিদ্র্যতা ফের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। একবছর পার না হতেই তার বাবার সামান্য আয়ে লেখাপড়া এবং আনুষঙ্গিক খরচ চালানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। লেখাপড়া বাদ দিয়ে বাড়িতে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। শুরু হয় এক হতাশাময় জীবন।
পড়াশুনার পাঠ চুকিয়ে এবার বেঁছে নিতে হয় কর্মজীবন। কিছুদিন বাড়িতে বসে থাকার পর ভাগ্যক্রমে ঢাকার ইএফসি. ইলেকট্রনিক ফেব্রিক সিরামিক নামে এক কোম্পানিতে চাকুরির সুযোগ হয়। বেতন খারাপ না, প্রায় ১৭০০০ হাজার টাকা। কিন্তু সেখানেও তার ভাগ্য তাকে সঙ্গ দেয়নি। কিছু অনাকাঙ্খি কারণে তিনি আবার ফিরে আসেন বাড়িতে।
সাধারণ মানুষের মত বাঁচা
বাড়িতে আসার পর মা-বাবার মন খারাপ। পাড়া-পড়শি বলাবলি করতেন, এই ছেলেকে দিয়ে কোন কাজ হবে না। সঞ্জিত স্মৃতি রোমন্থন করে বলে, “আমি যখন বাড়িতে ফিরে আসি। তখন নিজেকে নিজের কাছে খুব ছোট লাগতো। ভাবতাম আমার ভাগ্য কি এত খারাপ? কোন কাজে মন বসতো না। নিজের মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন জাগতো। খুব হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর ধীরে ধীরে বিভিন্ন কাজের সাথে সম্পৃক্ত হতে শুরু করলাম।” তিনি আরও বলেন, “প্রথমেই শুরু করলাম টিউশনি দিয়ে। বাড়ির আশেপাশের ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট পড়াতাম। পাশাপাশি, বাবার সাথে বাঁশ-বেঁতের কাজ করতাম। কিছুদিন পর আবার সরকারি দেবেন্দ্র কলেজে বাংলা অনার্সে ভর্তি হলাম। কম্পিউটার প্রশিক্ষণে ভর্তি হওয়ার অনেক ইচ্ছা ছিল। কয়েক মাস বারসিক’র সহযোগিতায় মন্দির ভিক্তিক বিদ্যালয়ে পড়াবার সুযোগ পেলাম। একই সাথে যুবউন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে কম্পিউটার প্রশিক্ষণেরও সুযোগ পেলাম। এখন বেশ ব্যস্ত সময় পার করি। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পড়াই, কলেজে যাই, কম্পিউটার শিখি। আবার সময় পেলে বাবার সাথে কাজ করি।”
সামাজিক মূল্যায়ন
হতাশ এক যুবক আজ তার পরিবার এবং সমাজে আলাদাভাবে সম্মান পায়। সঞ্জিত এর মুখ থেকে শোনা যাক সে কথা- “এখন পাড়-পড়শিরা আর কানাকানি করে না। ছেলেমেয়েরা যেখানেই দেখে- সেখানেই ‘স্যার! নমস্কার’ বলে। শিক্ষার্থীদের অভিবাবকরাও এখন ভালোভাবে কথা বলে। সমাজে লেখাপড়া বিষয়ক কোন কিছু হলেই আমার কাছে আসে-পরামর্শ নেবার জন্য। পাশাপাশি আমার সমাজে জন্য কিছু করতে পেরে আমারও ভালো লাগে। যেমন: এবার আমাদের পাড়া থেকে দেবু মনিদাস ও সুব্রতকে লেখাপড়ার পাশাপাশি মোবাইল সার্ভিসং এর কাজের সাথে যুক্ত করে দিয়েছি। সমাজের লোকজন এখন আমাকে মূল্য দিচ্ছে তাতেই আমি খুশি।”
স্বপ্নের পালাবদল
সঞ্জিত একদিন স্বপ্ন দেখেছিলেন এই দরিদ্র পরিবারে জন্ম নিয়েও উচ্চ শিক্ষিত হবেন; একজন ইঞ্জিনিয়ার হবেন। কিন্তু পারিবারিক আর্থিক সমস্যার কারণে সে স্বপ্ন পূরণ করতে পারলেন না। কিন্তু তার ছোট ছোট ভাইবোনদের মাঝে তার স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। সঞ্জিত এর ভাষায়, “শিশুদের পাশে যাতে দাঁড়াতে পারি সেটাই আমার স্বপ্ন। আমাদের দেশে বিশেষ করে আমাদের মনিদাস সমাজে অনেক অবহেলিত যুবক, কিশোরী এবং শিশু রয়েছে- তাদের এগিয়ে নিতে পারলে আমাদের জনগোষ্ঠী আর পিছিয়ে পড়ে থাকবে না। তাদের নিজেদের অধিকার নিজেরাই আদায় করতে পারবে।”
আমাদের গ্রাম গঞ্জে, সমাজে এমন অনেক যুবক আছেন। যারা জীবন এর কঠিন বাস্তবতার শিকার হয়ে ভেঙে পড়ে। হতাশায় ডুবে যায়, মনোবল ভেঙে যায়। সমাজে মানুষের কান-কথা তাদের সেই জীবনকে আরো বিষিয়ে তোলে। বাধ্য হয়ে মাদকাসক্তসহ নানা সমাজিক সমস্যায় জড়িয়ে পড়ে। খুব কম যুবকই তাদের সেই সম্ভাবনাকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে। তাদের সমাজে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে হয় সমাজে অনুকরণীয়। সঞ্জিত দাস তাদেরই একজন। সঞ্জিত মনিদাস মচকালো; কিন্তু ভাঙ্গলো না। নিজের মেধা, উদ্যোগ আগ্রহ দিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে অন্যদের দেখিয়ে দিয়েছেন আমিও পারি কিছু করতে। এজন্য আমাদের ইচ্ছা শক্তি ও চেষ্টাটাই বড় সম্বল।
আমরা যারা আপাত বড় হয়ে গিয়েছি। সমাজের হর্তা-কর্তা (!); সমাজ পরবির্তনে বদ্ধপরিকর। তাদের এই ধরনের হাজারো সম্ভাবনাময়, স্বাধীনচেতা, উদ্যমী সঞ্জিতদের ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে যুব সমাজকে গড়ে তোলার পরিকল্পনা করতে হবে। যেন এই তরুণরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। এই সব আত্মপ্রত্যয়ী সঞ্জিতদের স্বপ্নের সেই পথ সুগম করা আপনার আমার সবার দায়িত্ব।