বরেন্দ্র অঞ্চলে জিরা মসলা চাষের সফলতা
তানোর থেকে অমৃত কুমার সরকার ও মো. শহিদুল ইসলাম
প্রাচীন ভারতবর্ষ মসলা’র জন্য বিখ্যা হলেও বাংলা সব সময়ই মসলায় পিছিয়ে। এটা হতে পারে এই এলাকার ভৈাগলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে কিংবা কৃষকেরা কখনও হয়তো সেভাবে জিরা চাষের দিকে মনোনিবেশ করেননি। এই কারণে বর্তমান বাংলাদেশের অধিকাংশ মসলা আমদানিনির্ভর। বিশেষ করে জিরার জন্য বাংলাদেশ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের উপর নির্ভরশীল।
কিন্তু দিন বদলে গেছে। বদলে গেছে বাংলাদেশের প্রকৃতি, আবহাওয়া ও জলবায়ু। সাথে সাথে বদলাচ্ছে কৃষি, ফসল এবং কৃষকের জ্ঞান ও দক্ষতা। জলবায়ু পরিববর্তনের ফলে কৃষি ক্ষেত্রে নানা ধরনের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে খরা প্রধান বরেন্দ্র অঞ্চলে। তাই এই অঞ্চলের কৃষককে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে ফসল নির্বাচনের ক্ষেত্রেও। বরেন্দ্র এলাকার কৃষকরা পানিনির্ভর দানাদার শস্যের পরিবর্তে কম পানিনির্ভর শস্যের জন্য প্রতিনিয়ত পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাচ্ছেন। তেমনিই একটি ঘটনা হচ্ছে কৃষক মো. আব্দুল হামিদ এর মিসলা জাতীয় ফসল ‘জিরা’ চাষ এবং সেই চাষে সাফলতা অর্জন।
তার সেই সফলতাকে এলাকার আরো কৃষকের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য গত ৮ মার্চ রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার কলমা ইউনিয়নের বহড়া গ্রামে বারসিক ও বহড়া কৃষক সংগঠনের যৌথ আয়োজেন জিরা মসলা ফসলের মাঠ দিবস অনুষ্ঠিত হয়। খরা ও পানি সংকটাপন্ন বরেন্দ্র অঞ্চলের রাজশাহীর তানোর উপজেলার কলমা ইউনিয়নের বহড়া গ্রামের সংগ্রামী কৃষক মো. আব্দুল হামিদ দীর্ঘ দুইবছর পরীক্ষামূলক জিরা মসলা চাষ করেন। এই ক্ষেত্রে তিনি উল্লেখযোগ্য সফলতা পেয়েছেন।
মাঠ দিবসে অংশগ্রহণকারী কৃষকরা জিরা মসলার মাঠে প্রত্যক্ষভাবে ফসল পর্যবেক্ষণ করার পর চাষ পদ্ধতি, রোগ পোকার আক্রমণ এবং ফলন নিয়ে মতবিনিময় আলোচনা করেন। এই প্রসঙ্গে সফল জিরা চাষী আব্দুল হামিদ বলেন, “আমি ২০১৪ সাল থেকে এই জিরা নিয়ে পরীক্ষামূলক চাষ শুরু করি। ২০১৪ সালে ২ কেজি বীজ ১২ কাঠ জমিতে বুনে ছিলাম। সেবার আমি পেয়েছিলাম ১৭ কেজি জিরা। গত বছর অনেক বিষয় প্রত্যক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করছি এবং শিক্ষা নিয়েছি। কিন্তু চলতি বছর সেই শিক্ষা থেকে গত বছরের বীজ দিয়ে চলতি মৌসুমে আমি ১০ কাঠা জমিতে লাগিয়েছি। জিরাগুলো পরিপক্ক হয়েছে, পেকেছে। আশা করি এবার ২৫ থেকে ৩০ কেজি ফলন পাবো।” তিনি আরো বলেন, “আমাদের বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির সংকট। আর এই জিরা চাষে পানি কম লাগে একই সাথে খরা সহনশীল। তাই এটি চাষে আমরা ভালো ফলাফল পাবো।” তিনি আরো যুক্ত করেন যে, “এবার আমার বীজ নিয়ে বরেন্দ্র অঞ্চলের আরো তিনিটি জায়গায় এই জিরার চাষ হচ্ছে। আশাকরি সেগুলোর ফলাফলও ভালো হবে। তাহলে আমরা সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারবো যে, জিরা আমাদের এলাকার জন্য লাভজনক ফসল।”
একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বরেন্দ্র অঞ্চলে বিরূপ আবহাওয়া প্রতিফলিত হচ্ছে। অন্যদিকে ভূগর্ভস্থ পানি নির্ভর শস্য ফসলের চাষের কারণে দিনে দিনে খরা এবং পানি সংকট দেখা দিচ্ছে। এই লক্ষ্যে কমপানি নির্ভর বরেন্দ্র অঞ্চলের উপযোগি শস্য ফসলের চাষে বারসিক কৃষকদের চাহিদানুযায়ী সহায়তা করছে।
মাঠ দিবসের প্রধান অতিথি বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তপক্ষের চেয়ারম্যান ড. আকরাম হোসেন চৌধুরী বলেন, “বরেন্দ্র অঞ্চলের কমপানি নির্ভর শস্য ফসল নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। একজন তৃণমূল পর্যায়ের কৃষক নিজ উদ্যোগে জিরা চাষে সফলতা পেয়েছেন। এর চেয়ে বড় সুসংবাদ আর কী হতে পারে! এই জিরা চাষের সফলতা আমারা গোটা বরেন্দ্র অঞ্চলের ছড়িয়ে দিতে চাই।” তিনি আরো বলেন, “বরেন্দ্র অঞ্চলের সফল জিরা চাষ প্রথম এবং সম্ভবত গোটা বাংলাদেশেও কৃষক পর্যায়ে জিরা চাষে সফল কৃষক হামিদ। আমাদেরকে আব্দুল হামিদকে সম্মাননা জানানো জরুরি।” তানোর উপজেলার নির্বাহী অফিসার মুহা. শওকাত আলী বলেন, “সরকারের পক্ষ থেকে যতো ধরনের সহায়তা আছে আমরা তা দেওয়ার চেষ্টা করবো।”
কৃষি বিষয়ক গবেষণা করতে গেলে কৃষিবিদ কিংবা কৃষি বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষার প্রয়োজন নেই। একজন প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকও কৃষি বিষয়ে কার্যোপযোগি গবেষণা ফলাফল বয়ে আনতে পারেন। তারই একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত কৃষক মো. আব্দুল হামিদের জিরা চাষের গবেষণা। তার এই গবেষণালবদ্ধ জ্ঞান সমগ্র বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষি এবং কৃষকের জন্য এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে।