বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে প্রচুর পরিমাণে দেশীয় প্রজাতির বৃক্ষ রোপণের বিকল্প নেই
আব্দুর রাজ্জাক, মানিকগঞ্জ ॥
বেড়েই চলছে বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির সাথে বেড়েছে শিল্পায়ন ও নগরায়ন। এরই প্রভাবে অতিমাত্রায় বাড়ছে নাইট্রোজেন, সালফার ও কার্বন গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণ। প্রকৃতির এ পরিবর্তনে সামান্য বৃষ্টিপাতেও সৃষ্টি হচ্ছে অস্বাভাবিক বজ্রপাত। ফলে বেড়ে চলছে বজ্রপাতজনিত মৃত্যুর সংখ্যাও। চলমান সময়ের অন্যতম একটি বড় প্রাকৃতিক দূর্যোগের নাম “বজ্রপাত”। দেশব্যাপী এই দূর্যোগের আঘাতে মানুষসহ বিভিন্ন পশু পাখির প্রাণহানি হচ্ছে। বিগত বছর দুয়েক যাবত মানিকগঞ্জে বজ্রপাতের হার বেড়ে গেছে। একটি পরিসংখ্যান মতে, গত দু বছরে জেলার ৭টি উপজেলায় বজ্রপাতে নিহত হয়েছে ৩৭ জন। মারা গেছে অনেক গবাদী পশু ও গাছপালা। হতাহতের সংখ্যাও কম নয়। বজ্রপাতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে কমপক্ষে শতাধিক মানুষ। বজ্রপাতে যারা মারা যাচ্ছেন তাদের বেশিরভাগই মাঠে কাজ করেন।
গত রবিবার মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর ও সাটুরিয়া উপজেলায় বজ্রপাতে দুই শিশুসহ নিহত হয়েছেন পাঁচজন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরো ছয় ব্যক্তি। রবিবার দুপুরের দিকে সিঙ্গাইর উপজেলার বায়রা ইউনিয়নের কাটাখালি ও বিকেলে সাটুরিয়া উপজেলার হরগজ ইউনিয়নের চরপাড়া গ্রামে এই ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন, সিঙ্গাইরের জামালপুর গ্রামের নজগর আলীর ছেলে তাহের (৪০), একই গ্রামের আব্দুল খালেকের ছেলে আব্দুল বারেক (৪৫), রওশন আলীর ছেলে আসলাম হোসেন (৪০) ও সাটুরিয়ার হরগজ চরপাড়া গ্রামের মৃত গনেশ চন্দ্র সরকারের ছেলে জয়ন্ত চন্দ্র সরকার (১২) ও মৃত গোবরধনের ছেলে নিতাই চন্দ্র সরকার (১৬)।
বায়রা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দেওয়ান জিন্নাহ লাটু জানান, দুপুরে নিহত ওই তিনজনসহ আরও ১০/১২ জন কৃষক কাটাখালি চকে ধান কাটছিল। এসময় বজ্রপাত হলে ঘটনাস্থলে বারেক ও তাহের নিহত হয়। আহত ছয়জনকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালে পাঠায়। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আসলামের মৃত্যু হয়। আহত পাঁচজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। এদিকে হরগজ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন জ্যোতি জানান, বেলা তিনটার দিকে হরগজ চরপাড়া গ্রামে মাঠে কাজ করার সময় বজ্রপাতে জয়ন্ত সরকার ও নিতাই সরকারের মৃত্যু হয়। জয়ন্ত সরকার স্থানীয় হরগজ চরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ও নিতাই সরকার স্থানীয় হরগজ শহিদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র।
গত ২৪ মে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার জায়গীর এলাকায় আবদুস সালাম (৫৫) নামে এক কৃষক বজ্রপাতে নিহত হয়েছেন। আবদুস সালাম ওই এলাকার মৃত আবদুস সোবাহানের ছেলে। তিনি এক ছেলে ও দুই মেয়ে সন্তানের পিতা। বৃষ্টির মধ্যে বাড়ির পাশের মাঠে গরু আনতে গেলে তিনি বজ্রপাতের কবলে পড়েন। একই সময় বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছেন শিবালয় উপজেলার তারাইল গ্রামের মোশারফ হোসেনের স্ত্রী। বৃষ্টির সময় বাড়ির বাইরে কাজ করার সময় এ ঘটনা ঘটে। অন্যদিকে ২১ এপ্রিল বিকেলে মানিকগঞ্জের ঘিওরে বজ্রপাতে সুভা বেগম (৫৫) নামে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। উপজেলার বরাটিয়া ইউনিয়নের গোয়ালজান এলাকার নিজ বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে। নিহত সুভা বেগম ওই এলাকার মৃত তেনু মন্ডলের স্ত্রী।
সম্প্রতি-ঘিওর উপজেলার শ্রীধরনগর ও বেগুননাটি গ্রামে বজ্রপাতের পৃথক দুটি ঘটনায় ২ কৃষক নিহত হয়েছেন। নিহতরা হলেন উপজেলার শ্রীধরনগর গ্রামের মৃত ফয়জুদ্দিন সর্দার এর ছেলে সামেজ উদ্দিন সর্দার ও বেগুননাটি গ্রামের জাবেদ আলী মন্ডলের ছেলে ঠান্ডু মন্ডল। জানা গেছে, ঠান্ডু মন্ডল জমি থেকে বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ বজ্রপাত হলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। আর সামেজ দুপুরের দিকে গোসল করে বাড়ি ফেরার পথে বজ্রপাত হলে ঘটনাস্থলেই তারও মৃত্যু হয়।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার আটিগ্রাম ইউনিয়নের মাধবপুর গ্রামে বজ্রপাতে মনির হোসেন নামের এক নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। মনির ওই গ্রামের নুরুল ইসলামের ছেলে। স্থানীয়রা জানান, নিজ বাড়িতে ঘর নির্মাণের কাজ করছিলেন মনির। ওই সময় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সাথে হঠাৎ বজ্রপাত হয়। এতে তাঁর শরীরের বেশির ভাগ অংশ ঝলসে যায়। দ্রুত মানিকগঞ্জ জেলা হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান।
এছাড়া গত বছরের ১৩ জুন মানিকগঞ্জে সদর উপজেলার বারাহিরচর এলাকায় বজ্রপাতে আব্দুল হালিম (৪৫) নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। তিনি বারাহিরচর গ্রামের হযরত আলী মাতব্বরের ছেলে। বিগত বছরের ৬ জুন জেলার ঘিওর উপজেলার গোয়ালডাঙ্গি ও তারাইল গ্রামে বজ্রপাতে ২ নারীর মৃত্যু হয়েছে। সোমবার বেলা ২টার দিকে এই ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন গোয়ালডাঙ্গি গ্রামের চায়না আক্তার (৩২) ও তারাইল গ্রামের বিলকিস বেগম স্বপ্না (৪৫)। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দুপুরে বৃষ্টির সময় প্রচন্ড বজ্রপাত হচ্ছিল। এ সময় বাড়ির উঠানে কাজ করার সময় চায়না বেগমের ওপর বজ্রপাত হয়। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। চায়না ২ ছেলে সন্তানের জননী। এদিকে একই সময় ঘিওরের বানিয়াজুরি বাসস্ট্যান্ড থেকে বাড়ি ফেরার পথে বিলকিসের ওপর বজ্রপাত হলে তার মৃত্যু হয়। তিনি ৩ ছেলে ও ২ মেয়ে সন্তানের জননী।
বজ্রপাত সংঘটনের বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে স্থানীয় মানুষ কারণ হিসেবে গাছপালা কমে যাওয়াকেই বেশি দায়ি করেন। একই সাথে অভিজ্ঞজন মনে করেন, এ অঞ্চলে একসময় প্রচুর তাল, খেঁজুর এবং বড় বড় বট পাইকড়সহ নানা জাতের গাছের বৈচিত্র ছিলো। দিনে দিনে এসব কমে যাবার ফলে বজ্রপাতের সংঘটনের হার বেড়েছে। গাছপালা কমে যাওয়া এবং প্রাকৃতিক দূর্যোগে জলাভূমিগুলো কমে যাবার কারণে বজ্রপাত সরাসরি প্রাণের প্রতি আকর্ষিত হচ্ছে। যার ফলে বজ্রপাতে প্রাণহানি হচ্ছে।
মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার বানিয়াজুরী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কাশেম চতু বলেন, “প্রকৃতির উপর আমরা যেভাবে হাত খেলাচ্ছি এর ফলে পরিবেশের স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। খেঁজুর ও তাল গাছগুলো দেদারসে কেটে ফেলছি। এই কারণে বিজলি সরাসরি মানুষসহ অন্যান্য গবাদি পশুর উপর পড়ছে।”
বিজ্ঞানের পরিভাষায়, পানি চক্রের নিয়ম আনুযায়ী জলীয়বাষ্প যখন সূর্যের তাপে উপরে উঠতে থাকে তখন অন্যান্য বায়ু ও জলীয় কনার সাথে ঘর্ষনের ফলে বিদ্যুৎ তৈরি হয়। ফলে একেকটা জলীয় কণা ব্যাটারির মত কাজ করে।ইলেক্ট্রন জলীয় কণার নিচের দিকে বেশি অবস্থান করে বলে এই অংশে ঋনাত্মক চার্জ জমা হয় আর উপরে ধনাত্মক চার্জ জমা হয়। যখন এই ধনাত্মক ও ঋনাত্মক চার্জ মিলিত হয় তখনই বজ্রের সৃষ্টি হয়।এই সময় তড়িৎ বিভবের পার্থক্য ১০ মিলিয়ন ভোল্ট পর্যন্ত হতে পারে আর তরিৎ প্রবাহের মাত্রা ৩০,০০০ এম্পায়ার পর্যন্ত হতে পারে। বিভবের পার্থক্যের উপর প্রবাহের মাত্রা নির্ভর করে। এই সময় বাতাসের তাপ মাত্রা ২০০০০ থেকে ৩০০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যায়। এই প্রচন্ড শক্তির স্থায়িত্ব মাত্র সেকেন্ডের দশ ভাগের এক ভাগ।
আবহাওয়া অধিদফতরের রেকর্ড অনুযায়ী, গত ৫ বছরে (২০১১-২০১৫) সারাদেশে ৫ হাজার ৭৭২টি বজ্রপাত হয়। এর মধ্যে ২০১১ সালে ৯৭৮, ২০১২ সালে ১ হাজার ২১০, ২০১৩ সালে ১ হাজার ৪১৫, ২০১৪ সালে ৯৫১ ও ২০১৫ সালে ১ হাজার ২১৮ বজ্রাঘাত হেনেছে বাংলাদেশে।
বাংলাদেশ সরকারের দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন তথ্য উপাত্তসহ স্থানীয় মানুষের কাছ থেকে বজ্রপাত থেকে নিরাপদ থাকতে কিছু করণীয় দিক সম্পর্কে জানা যায়। বজ্রপাতের সময় আমরা একটু সচেতন হলে এর হাত থেকে রক্ষা পেতে পারি। যেমন:
১. বজ্রপাতের সময় কোন খোলা মাঠে বা খোলা স্থানে দাঁড়ানো যাবে না। সেই সাথে কোন গাছের নীচে আশ্রয় নিবেন না। গাছের উপর বজ্রপাত বেশি হয়।
২. পানির কাছে থাকা যাবে না। রাস্তায় সাইকেল বা মটরসাইকেলের উপর থাকলে, দ্রুত নিরাপদ স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে। ৩. যদি খোলা মাঠ বা খোলা জমিতে থাকেন, তবে লক্ষ্য করুন তার টানা কোন বৈদুত্যক খুটি আছে কিনা। যদি থাকে তবে দুই খুটির মাঝখানে তারের নিচে পায়ের পাতা উচু করে পাতার উপর মাথা নিচু করে বসে থাকুন।
৪. বজ্রাহত কোন ব্যক্তিকে কখনো খালি হাতে স্পর্শ করবেন না, কারণ তার শরিরে তখনও বিদ্যুত থাকতে পারে।
বেসরকারি উন্নয়ন ও গবেষণা সংস্থা “বারসিক” এর মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক প্রকল্প সমন্বয়কারী বিমল রায় বলেন, “বজ্রপাতে নিজে সতর্ক থাকা এবং অন্যকেও সতর্ক থাকতে পরামর্শ দেওয়া উচিত। বজ্রপাতের করণীয় দিকগুলো মানুষের মধ্যে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে দিলে মানুষসহ সকল প্রাণহানি কমে যাবে।” তিনি আরও বলেন, “দীর্ঘস্থায়ী হিসেবে বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে প্রচুর পরিমাণে তাল, খেঁজুর এবং দেশীয় প্রজাতির বৃক্ষ রোপণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। একই সাথে বড় বড় গাছসহ তাল এবং খেঁজুর গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে।”