মানিকগঞ্জে নানা সংকটে হারিয়ে যাচ্ছে মৃৎশিল্প
মানিকগঞ্জ থেকে আব্দুর রাজ্জাক ॥
চার পুরুষের পেশা ছাড়তে না পেরে কষ্টে জীবন পার করছেন মানিকগঞ্জের পাল সম্প্রদায়ের হাজারো পরিবার। বর্তমানে পাল সম্প্র্রদায়ের করুণ অবস্থা দেখে এই পৈত্রিক পেশা বদল করে অন্য পেশায় ঝুঁকে পড়ছেন অনেকে। এক সময় পাল সমপ্রদায়ের হাতের তৈরি মাটির বাসন-কোসনের কদর ছিলো প্রচুর। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে পাল সমপ্রদায়ের তৈরি জিনিস। এই আধুনিক যুগে সিলভার, ইস্টিল, মেলামাইন, কাচের ব্যবহারিক সামগ্রিক হাতের নাগালে পাওয়াতে বাজার দখল করে নিয়েছে। এ কারণে হারিয়ে যাচ্ছে মৃৎ শিল্প।
যুগযুগ ধরে জীবন ও জীবিকার তাগিদে গড়ে উঠেছে পাল সমপ্রদায়ের। ঠিক তেমনিভাবে গড়ে উঠেছিল ৪০০ বছর আগে ধানকোড়া ইউনিয়নের উত্তর খল্লী বর্তমানে (জমিদার বাড়ি) নামে পরিচিত পাল বাড়ি। নদীর তল দেশ থেকে এঁটেল মাটি তোলা এবং বিভিন্ন প্রকার পাতিল, তাওয়া, কলস, ঝাঁঝড়, কান্দা, হাতা, সরাসহ নানা ধরনের হাঁড়ি-কুড়ি তৈরি করে তা আবার গ্রামে গ্রামে ঘুড়ে বিক্রয় করতেন তারা। জলবায়ু পরির্বতনের সঙ্গে সঙ্গে নদীর হারিয়ে যেতে বসেছে যার প্রভাব পড়ছে পাল সমপ্রদায়ের উপর। উপযুক্ত এঁটেল মাটি না পাওয়ার ফলে মাটির তৈরি পাত্র টেকসই হচ্ছে না। এই কারণে চড়া মূল্য দিয়ে গাজিপুর, কুমিল্লা, লাকসাম থেকে মাটি ক্রয় করতে হচ্ছে তাদের। এক ট্রাক মাটির মূল্য পড়ছে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা। এক ট্রাক মাটি দিয়ে যে হাঁড়ি-পাতিল হয় তা বিক্রয় করে কোন রকমে চালান উঠে আবার অনেক সময় লোকসানও গুণতে হয়। তাতেও ভালোভাবে চলতে পারছে না পালেরা। দিন কাটছে ওদের নিদারুণ কষ্টে।
এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত অনেকেই বাপ-দাদার এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়ছেন। দৌলতপুর গ্রামের বদন কুমার পাল, সাধন কুমার পাল, হাজারি কুমার পাল, বাবু কুমার পাল ও কার্তিক কুমার পাল জানান, অভাব অনটনের মধ্যেও হাতেগোনা কয়েকটি পরিবার বাপ-দাদার পেশা আঁকড়ে ধরে আছেন। মাটির হাঁড়ি-পাতিল, ঢাকনা হাট-বাজারে ভ্যানভাড়া দিয়ে হাটে আনলেও জিনিস বিক্রি হয় না। এখন তাদের অনেকেরই অবস্থা শোচনীয়। তাঁরা জানান, হাঁড়ি-পাতিল ও অন্যসব জিনিসপত্র তৈরি করতে কাঁচামাল এটেল মাটি তাদের গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বিভিন্ন নদী থেকে সংগ্রহ করা যেত। বর্তমানে নদী ভরাটের কারণে নদী থেকে আর মাটি তোলা যায় না। তাই পাশের গ্রাম থেকে টাকা দিয়ে মাটি কিনে ভ্যানে করে আনতে হয়।
বাধ্য হয়ে চার পুরুষের এই পেশা থেকে সড়ে আসতে হচ্ছে তাদের। এ পরির্বতনের সঙ্গে টিকতে না পেড়ে পাল সমপ্রদায়ের মৃৎ শিল্পীরা হারাতে বসেছেন তাদের পারিবারিক ঐতিহ্য। নানা প্রতিকূলতা আর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না পাওয়ায় অনেকেই এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন।
মৃৎ শিল্পী বিন্দু রানী পাল জানান, মাটির পাতিলে রান্না করলে সহজে খাবার নষ্ট হয় না। এছাড়া স্বাদও বেশি হয়। শরীরেরও কোন ক্ষতি করে না। এখন তো আগের মতো মাটির হাঁড়ি-পাতিল আর চলে না। তিনি বলেন, “আমরা জন্মের পর থেকে এক কাজ বাবা, দাদাদের করতে দেখছি। তাই অন্য কোন কাজ শিখি নাই যার কারণে এ কাজই করে খাই।” তিনি আরও বলেন, “সারাজীবন কাজ করে কিছুই জমাইতে পারি নাই। এ কাজ করে আমি এক ছেলেকে মাস্টার্স পাস করাইছি, মেয়ে বিএ অনার্সে পড়ে এবং ছোট ছেলে আমার সঙ্গে মাটি কাজ করে। আমি চাই আমার মতো যাতে এত কষ্ট করতে না হয় ওদের। ভগবানের একটা চাওয়া যাতে ওদের এ কাজ করতে না হয়, ভালো চাকরি হতো ওদের।”
আরও এক মৃৎ শিল্পী জগদিস পাল বলেন, “নিজের জীবনতো এ কাজেই শেষ করলাম কিন্তু আমার সন্তান কমল পালকে লেখাপড়া শিখাইতাছি যাতে অন্য কাজ করতে পারে। কারণ চার পুরুষের মতো কষ্টের জীবন আমার সন্তানও বহন করুক তা আমি চাই না।” তিনি আরও বলেন, “বর্তমানে এ শিল্পে যে অবস্থা চলছে এখন সব কিছুই কিনতে হয় চড়া দামে। একদিকে খরচ বেড়ে গেছে আবার অন্য দিকে এসবের চাহিদাও কমে গেছে। আগে হাঁড়ি-পাতিল পোড়ানোর জন্য সহজেই জ্বালানি পাইতাম এখন তাও আর পাওয়া যায় না।”
এ শিল্পতে বাচাতে চাইলে দ্রুত সময়ের ভেতর সরকারের সহযোগিতা খুব দরকার। তা না হলে এ শিল্প ধ্বংসের সম্ভাবনা রয়েছে।