বরেন্দ্রভূমির কৃষকের লুপ্তপ্রায় স্থানীয় ধানজাতের প্রায়োগিক গবেষণা
এবিএম তৌহিদুল আলম ও অমৃত সরকার
উচ্চ বরেন্দ্রভূমি কৃষিপরিবেশের অর্ন্তগত বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মৌসুমি খরা প্রবন শুষ্ক অঞ্চল চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল উপজেলা ও রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার আগ্রহী কৃষক ও বারসিক যৌথভাবে পানি সাশ্রয়ী, কম উৎপাদন ব্যয় ও পরিবর্তিত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে বরেন্দ্র এলাকার জন্য উপযোগি ধানজাত নির্বাচনের লক্ষ্যে লুপ্তপ্রায় স্থানীয় ধানজাত নিয়ে প্রায়োগিক গবেষণা আরম্ভ করে। বিগত ২০১২-১৩ বোরো মৌসুম থেকে বর্তমান ২০১৭ সাল পর্যন্ত স্থানীয় কৃষকের নেতৃত্বে পরিচালিত এই গবেষণায় লুপ্তপ্রায় স্থানীয় ৭৫টি ও সংকরায়ণের মাধ্যমে প্রাপ্ত ১৩টি নির্বাচিত লাইন ব্যবহৃত হয়েছে।
বিভিন্ন মৌসুমের গবেষণা ফলাফলে দেখা যায়, স্থানীয় কৃষকরা চিনিশংকর, খৈলঝুড়ি, অহনা, রাঁধুনীপাগল, সোহাগ-৪, কালোজিরা, সুবাশ, জামাইসোহাগী জাতগুলি ফলন, তুলনামূলক কম সেচ, উৎপাদন খরচ, স্বাদ ও বাজার মূল্যের বিবেচনায় পছন্দ করেছেন। গবেষণাধীন জাতগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ফলন পাওয়া গেছে চিনিশংকর জাতে ৫.৮টন/হে যার জীবনকাল ১৫২ দিন ও প্রতি হাজার দানার ওজন ৩৫ গ্রাম আর প্যানিকেলের দৈর্ঘ্য ২৮.৫ সেমি। একই পরিচর্যায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ফলন পাওয়া গেছে খৈলঝুড়ি (৫.০৪টন/হে) জাতে। অন্যান্য জাতের ফলন হলো অহনা (৪.৪৯ টন/হে), রাঁধুনীপাগল (৪.০৯ টন/হে), সোহাগ-৪ (৪.০৯ টন/হে), কালোজিরা (৩.৬ টন/হে), সুবাশ (৩.৪ টন/হে), জামাইসোহাগী (৩.৪ টন/হে)। গাছের উচ্চতা সর্বোচ্চ ১৩৬ সে.মি পাওয়া গেছে জষ্ঠা জাতে। আর সর্বনি¤œ উচ্চতা বিশিষ্ট জাত হলো কালিজিরা। এ জাতের গাছের উচ্চতা ৫৩ সেন্টিমিটার। শিকড়ের সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ২৭ সেমি দেখা গেছে, জেসমিন জাতে। গবেষণায় কৃষকের স্থানীয় জ্ঞান রোগবালাই ও পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণে জৈববালাই নিবারক ব্যবহার করা হয়েছে।
লুপ্তপ্রায় স্থানীয় ধানজাত দেশের অমূল্য প্রাণসম্পদ। কেননা প্রতিটি ধানজাতই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র এবং প্রতিটি জাতেই রয়েছে হরেক গুণাবলী যেমন সুগন্ধ, সরু, মোলায়েম, কাঠিন্য, আকর্ষনীয় রঙ, সুস্বাদু, পুষ্টিগুণ, আঠালোভাব, সংরক্ষণগুণ, লবণাক্ততা, খরা প্রতিরোধ ক্ষমতা, জলাবদ্ধ সহিষ্ণুতা, রোগ-পোকার আক্রমণ সহনশীলতা ও ঔষধি গুণ। বরেন্দ্র এলাকার বিভিন্ন গ্রামে পরিচালিত গবেষণা, কৃষকের আগ্রহ ও প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার দুবইল গ্রামে স্থানীয় কৃষকরা মিলে তৈরি করেছেন বরেন্দ্র কৃষক বীজব্যাংক। বরেন্দ্র কৃষক বীজব্যাংকটিকে মোট ৮৬ ধরনের আমন, ৮ ধরনের আউশ ও ৬ ধরণের বোরো ধানের লুপ্তপ্রায় স্থানীয় জাত রয়েছে যা কৃষকরা বীজব্যাংক’র বীজ লেনদেনের জন্য নিজেদের তৈরি নিয়মের মাধ্যমে প্রয়োজন অনুযায়ী লেনদেন করছেন। বর্তমানে এই কৃষক বীজ ব্যাংক থেকে বীজ সংগ্রহ করে বিভিন্ন এলাকার কৃষকরা নিজেদের জমিতে চাষাবাদ করছেন। লুপ্তপ্রায় স্থানীয় ধানজাতগুলোর মধ্যে খৈলঝুড়ি, অহনা, জামাইসোহাগী, সুবাশ, কালোজিরা, রাঁধুনীপাগল, সোহাগ-৪, মাগুরশাইল, চিনিশংকর, ঝিঙ্গাশাইল ও বাদশাভোগ এই ১১টি জাত ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৬টি জেলার ১৪টি উপজেলার ২৬ টি গ্রামের ৪৩৪ জন কৃষক ৩১.০৬ হেক্টর (২৩২.৯৫ বিঘা) জমিতে চাষাবাদ করেছেন।
১. উচ্চ বরেন্দ্রভূমি : বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমের শুষ্ক অঞ্চল
বরেন্দ্রভূমি হলো বঙ্গ অববাহিকার বৃহত্তম প্লাইসটোসিন ভূ-প্রাকৃতিক একক। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে ‘বর’ শব্দের অর্থ হচ্ছে আশীর্বাদ এবং ‘ইন্দ্র’ শব্দের অর্থ দেবতাদের রাজা। অর্থাৎ ইন্দ্রের বর বা ইন্দ্রের আশীর্বাদ থেকে বরেন্দ্র শব্দটির উৎপত্তি। প্রায় ৭,৭৭০ বর্গ কি.মি. এলাকাজুড়ে বরেন্দ্রভূমি বিস্তৃত। বরেন্দ্রভূমির ভৌগোলিক অবস্থান মোটামুটি ২৪০২০ইঞ্চি উত্তর অক্ষাংশ থেকে ২৫০৩৫ইঞ্চি উত্তর অক্ষাংশ পর্যন্ত এবং ৮৮০২০ইঞ্চি পূর্ব দ্রাঘিমাংশ থেকে ৮৯০৩০ইঞ্চি পূর্ব দ্রাঘিমাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত। উত্তর-পশ্চিম বরেন্দ্রভূমি বলয়ের মধ্যে রয়েছে দিনাজপুর, রংপুর, পাবনা, নাটোর, রাজশাহী, বগুড়া, জয়পুরহাট ও নওগাঁ জেলাসমূহ।
পুরাতন পলল দিয়ে গঠিত উচ্চ বরেন্দ্র অঞ্চল দেশের বাদবাকী অঞ্চলের জলবায়ুগত অবস্থার বিপরীতে এখানে সুস্পষ্টভাবে চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া। দেশের অন্যান্য স্থানের তুলনায় বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রাকৃতিক চিত্রটি সম্পূর্ন ভিন্ন। রোদে পোড়া উত্তপ্ত উঁচু-নিচু বিস্তীর্ণ মাঠ, বাবলা, ক্যাকটাস ও গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ ও মাঝে মাঝে তাল গাছের উপস্থিতি এই এলাকার সাধারণ দৃশ্য। এই এলাকার জলবায়ু অত্যন্ত রুক্ষ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনেক কম। এই অঞ্চল সাধারণভাবে উষ্ণ ও অর্ধশুষ্ক বলে বিবেচিত। গ্রীষ্মকালে বরেন্দ্র অঞ্চলের গড় তাপমাত্রা ৩৫০ থেকে ২৫০ সেন্টিগ্রেডের মধ্যে এবং শীতকালে ১২০ থেকে ১৫০ সেন্টিগ্রেডের মধ্যে উঠানামা করে। (গ্রীষ্মকালে সর্বোচ্চ গরমের সময় রাজশাহী এবং বিশেষ করে নাটোর জেলার লালপুরে তাপমাত্রা ৪৫০ সেন্টিগ্রেড বা তারও বেশি হয়। আর শীতকালে দিনাজপুর ও রংপুরের কিছু অঞ্চলে তাপমাত্রা এমনকি ৫০ সেন্টিগ্রেডেরও নিচে নেমে যায়। আবহাওয়া বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে এ অঞ্চলের খরাকে মৌসুমি খরা, যা বর্ষা ও শীত মৌসুমের সাধারণ নিয়মের ব্যত্যয় থেকে ঘটে; এবং আপদকালীন খরা যা অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের কারণে ঘটে বলে অভিহিত করেছেন। এখানে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ প্রায় ১,৯৭১ মিলিমিটার যা প্রধানত বর্ষা মৌসুমেই হয়ে থাকে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এলাকা ও বছর ভেদে ভিন্ন হয় থাকে। উদাহরণ স্বরূপ, ১৯৮১ সালে রেকর্ডকৃত বৃষ্টির পরিমাণ ছিল প্রায় ১,৭৩৮ মিমি, কিন্তু ১৯৯২ সালে ছিল ৭৯৮ মিমি। বৃষ্টিপাতের বণ্টনও স্থানভেদে ভিন্ন ভিন্ন। তাই বরেন্দ্র অঞ্চল দেশের মধ্যে খরাপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত।
২. লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
প্রায়োগিক গবেষণার মাধ্যমে বরেন্দ্র এলাকায় খরা ও পানি সাশ্রয়ী লুপ্তপ্রায় স্থানীয় ধানজাতের অনুসন্ধান করা। এজন্য নি¤œলিখিত সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে-
ক. বরেন্দ্র এলাকার লুপ্তপ্রায় স্থানীয় ধানজাতের অনুুসন্ধান করা,
খ. পরীক্ষণের মাধ্যমে লুপ্ত প্রায় স্থানীয় ধানজাতের মধ্য থেকে পানি সাশ্রয়ী জাত নির্বাচন করা এবং
গ. কৃষকের পছন্দের লুপ্তপ্রায় স্থানীয় জাতের ধানবীজ সহজলভ্য করা।
৩. গবেষণা পদ্ধতি
গবেষণাটিতে বিভিন্ন উৎস থেকে বরেন্দ্র এলাকার লুপ্তপ্রায় স্থানীয় ধানজাত সম্পর্কে তথ্য ও প্রায়োগিক গবেষণার জন্য স্থানীয় ধানজাত সংগ্রহ করা হয়েছে। গবেষণা পরিচালনার পূর্বে মাধ্যমিক তথ্য পর্যালোচনা ও ফোকাস গ্রুপ ডিসকাসনের মাধ্যমে গবেষণার সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে গবেষণা প্রতিবেদন ও মাঠ গবেষণা চলাকালীন সুনির্দিষ্ট তথ্য ছকের মাধ্যমে সাপ্তাহিক ভিত্তিতে সংগৃহীত তথ্যের পর্যালোচনা করা হয়েছে। দক্ষ কর্মী ও অভিজ্ঞ কৃষকের মতামত সম্বলিত পূরণকৃত সাপ্তাহিক তথ্যছক এই গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণের অন্যতম ভিত্তি। এছাড়াও গুণগত তথ্যের সত্যতা ও যথার্থতা নিশ্চিত করতে ইনডেপথ ইন্টারভিউ এবং স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকেও তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
৪. সুযোগ ও সীমাবদ্ধতা
লুপ্তপ্রায় স্থানীয় ধানজাত নিয়ে প্রায়োগিক পর্যায়ে তেমন গবেষণা না থাকায় পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। একই কারণে মাধ্যমিক উৎস থেকেও তথ্য সংগ্রহ করা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য হয়েছে।
৫. গবেষণা এলাকার বর্ণনা
কৃষক নেতৃত্বে লুপ্তপ্রায় স্থানীয় ধানজাতের প্রায়োগিক গবেষণা কার্যক্রমটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল উপজেলার ৮ কিঃমিঃ দক্ষিণে নেজামপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত আমনূরা-নাচোল মহাসড়কের পূর্বে অবস্থিত বরেন্দ্রা গ্রাম এবং একই উপজেলার পশ্চিমে কসবা ইউনিয়নের খড়িবোনা গ্রাম যেখানে ফসলী জমির বড় একটি অংশ হাজার বিঘা বিলে অবস্থিত সেখানে গবেষণাটি সম্পন্ন হয়েছে। খড়িবোনা গ্রামের শতকরা ৯৫ ভাগ কৃষকই বর্গা চাষী। গ্রামের প্রধান ফসল ধান হলেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পেয়ারা, বড়ই ও আম বাগান রয়েছে। এখানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে একক ফসলের বাগান হওয়ায় কমছে মাঠফসলী জমি। বরেন্দ্রা গ্রামের মধ্যভাগে ৩০ বিঘা আয়তনের একটি দিঘী আছে যার আয়ে গ্রামে বসবাসকারী সকল সম্প্রদায়ের মানুষের ও বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক কাজ করা হয়ে থাকে। এছাড়াও গবেষণা কর্মটি রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলা সদর থেকে ৩ কিলোমিটার পশ্চিমে তালন্দ ইউনিয়নের আড়াদিঘী গ্রাম ও একই উপজেলার গোকুলমথুরা গ্রামেও পরিচালিত হয়। আড়াদিঘী গ্রামে ২৬ বিঘার একটি দিঘী আছে যেখান থেকে এই গ্রামের সকল পরিবারে উন্নয়নের কাজ করা হয়। গবেষণাধীন সকল গ্রামের মানুষের প্রধান জীবিকা হলো কৃষি এবং আমন ধান হলো প্রধানতম উৎপাদিত শস্য। তবে সেচনির্ভর বোরো ধানও চাষ হয়। বোরো ধান সম্পূর্র্ণভাবে এবং আমন ধানের ফুলধারণ পর্যায়ে গ্রামগুলিতে ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভর করেই চাষাবাদ করতে হয়। গবেষণাধীন চারটি গ্রামেই আদিবাসী জনগোষ্ঠির বসবাস রয়েছে। গবেষণাধীন গ্রামগুলোর মধ্যে বরেন্দ্রা গ্রামে ভূগর্ভস্থ পানির অভাবে বোরো চাষের অধীন জমির পরিমাণ কমে রবিশস্য বিশেষত মসুর, মটর, ছোলা, সরিষা, গম ও যব চাষ দ্র”ত হারে বাড়ছে।
৬. লুপ্তপ্রায় স্থানীয় ধানজাতের প্রায়োগিক গবেষণা : সমস্যা সমাধানে কৃষকের প্রয়াস
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, অতীতে বরেন্দ্র এলাকার কৃষি বৃষ্টি নির্ভর ছিল। সে সময় বছরে একটি ফসল উৎপন্ন হতো। যথাসময়ে বৃষ্টিপাত না হলে সেটির উৎপাদনও ব্যহত হতো। বরেন্দ্র এলাকায় গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূ-গর্ভস্থ পানি দ্বারা সেচের সুযোগ সৃষ্টি হয় ১৯৮৫। বিএডিসির প্রকৌশলীদের উদ্ভাবিত গভীর নলকূপের মাধ্যমে তখন বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রথম সেচ দেওয়া আরম্ভ হয়। মাটির গঠন এবং ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরের কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রচলিত অগভীর নলকূপ দ্বারা সেচ কাজ সম্ভব ছিল না। এর প্রেক্ষিতে বরেন্দ্র এলাকার সার্বিক উন্নয়নের জন্য রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার ১৫টি উপজেলাকে সম্পৃক্ত করে বিএডিসি’র অধীনে বরেন্দ্র সমন্বিত এলাকা উন্নয়ন প্রকল্প (Barind integrated Area Development) নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এ প্রকল্পের আওতায় ছিল সেচ কাজের জন্য গভীর নলকূপ স্থাপন, সংস্কারের অভাবে পানির ধারণ ক্ষমতা না থাকা পুকুর ও খাল পুনঃখনন, বৃক্ষরোপণ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে সড়ক নির্মাণ। প্রকল্পটির সাফল্যর কারণে সমগ্র বরেন্দ্র এলাকার উন্নয়নের জন্য ১৯৯২ সালে রাজশাহী, চাঁপাই নবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার সমগ্র ২৫টি উপজেলাকে অন্তর্ভূক্ত করে বিএডিসির কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে বরেন্দ্র বহুমূখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (Barind Multipurpose Development Authority(BMDA) গঠিত হয়।
বরেন্দ্র এলাকায় উৎপাদিত প্রধান কৃষিপণ্য হলো ধান। এখানে ধানের উৎপাদন মৌসুম প্রধানত দু’টি। আমন ও বোরো। উভয় মৌসুমেই সাধারণত বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে ছাড়কৃত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান চাষ করা হয়। তবে খুব কম পরিমাণ জমিতে স্থানীয় জাতেরও চাষাবাদ করা হয়। উচুঁ বরেন্দ্র এলাকায় সাধারণত বৃষ্টি নির্ভর দীর্ঘমেয়াদি স্বর্ণা পাঁচ, গুটি স্বর্ণা, মামুন স্বর্ণা, হুটরা ইত্যাদি জাতের রোপা আমন ধানের চাষ হয়। কোন বছর বৃষ্টিপাত দেরিতে শুরু হওয়ায় বা আগাম শেষ হওয়ায় দীর্ঘমেয়াদি স্বর্ণা জাতের রোপা আমন ধানের দানা পুষ্ট হওয়ার পূর্বেই মাটিতে রসের ঘাটতি দেখা দেয় এবং সম্পুরক সেচ দেওয়া না হলে ফলন কমে যায়। এছাড়া পরবর্তী রবি ফসল করার জন্য অনেক বছর জমিতে ‘জো’ (স্থানীয় ভাষায় বাতাল) থাকে না এবং সঠিক সময়ে অন্যান্য রবি ফসল যেমন-গম, ছোলা, সরিষা, মসুর ইত্যাদি বপন করা সম্ভব হয় না।
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করণের নিমিত্তে বরেন্দ্র অঞ্চলকে শস্যভান্ডারে রূপান্তর, জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজনের লক্ষ্যে জলাধার উন্নয়ন ও ব্যাপক বনায়ন, উৎপাদিত কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণের জন্য প্রত্যন্ত অঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সরকারের আর্থিক সহায়তায় বিএমডিএ কর্তৃক বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণের ফলে বরেন্দ্র এলাকার কৃষি, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং পরিবেশের উন্নয়নসহ জনগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। এখন আর জনসাধারণকে কাজের সন্ধানে অন্যত্র গমন করতে হয় না। বিএমডিএ’র কার্যক্রমে সাফল্যের কারণে পর্যায়ক্রমে রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের সকল জেলায় কর্তৃপক্ষের কার্যক্রম বিস্তার লাভ করেছে।
ক্রমান্বয় ভূগর্ভস্থ পানিই পরিণত হয়েছে বরেন্দ্র এলাকার ফসলের জমির সেচের অন্যতম প্রধানতম উৎস। কিন্তু পূর্বের তুলনায় পানি যেমন বেশি দামে যেমন কিনতে হচ্ছে তেমনি পোহাতে হচ্ছে পানি কেন্দ্রিক নানা ধরণের দূর্ভোগ। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় ক্রমান্বয়ে কমছে একটি গভীর নলকূপের আওতাধীন জমির পরিমাণ। ইতোমধ্যে কোনো কোনো এলাকার পানির স্তর ডিপের আওতার নিচে নেমে গেছে। বরেন্দ্র বহুমূখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ পর্যায়ক্রমে গভীর নলকূপ স্থাপনের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন এবং পুকুর ও খাড়ি সংস্কারের মাধ্যমে পানি সংরক্ষণ করে সেচ ব্যবস্থার উন্নতি করার পরেও উচুঁ বরেন্দ্র অঞ্চলের ১ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে এখনও প্রায় ৫৫ ভাগ জমির আবাদ সম্পূর্ণ বৃষ্টিনির্ভর। এর মধ্যে অনেক এলাকা সেচের আওতায় আসার সম্ভাবনা খুবই কম, কারণ পানির স্তর খুবই নীচে। তদুপরি সেচ নির্ভর বোরো আবাদের জন্য যথেচ্ছাভাবে গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত উত্তোলন, সেচ পানির অপচয় এবং বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় এ অঞ্চলের পানির স্তর ক্রমশই নীচে নেমে যাচ্ছে। বিশ বছর পূর্বে অগভীর নলকূপ থেকে যেখানে পানি পাওয়া যেত, সেখানে বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রেই আর পানি উত্তোলন করা সম্ভব হচ্ছে না। সাপাহার, নাচোল, গোদাগাড়ী, নিয়ামতপুর, পোরশা ও পতœীতলা ও ধামুরহাট উপজেলার বেশিরভাগ জমি স্বর্ণা জাতের রোপা আমন ধান কাটার পর পতিত থাকে। এসব এলাকায় খরা সহনশীল উপযুক্ত ফসল ও জমি নির্বাচন করে একই জমিতে বছরে ৩টি ফসলের আবাদ এবং সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এদের ফলন বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।
পানি সঙ্কটের এই পরিস্থিতি এলাকার কৃষকদের মনে চিন্তার উদ্রেক করে। প্রাকৃতিক এই অবস্থার সাথে মানিয়ে নিতে এখানকার কৃষকরা চাষাবাদে ভিন্নতা আনার চেষ্টা করছেন। তারা পানি সাশ্রয়ী ফসল চাষাবাদের চেষ্টা করছেন। বরেন্দ্র এলাকার জন্য খরা সহনশীল এবং কম সময়ে আবাদ করা যায় এমন ধানজাতের কৃষক পর্যায়ে চাহিদা রয়েছে। চাহিদা পূরণে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রচেষ্টাও রয়েছে। বারসিক-রাজশাহী রিসোর্স সেন্টার বিষয়টি নিয়ে এলাকার বিভিন্ন গ্রামের কৃষকদের সাথে আলাপচারিতা, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনার মাধ্যমে ২০১২-১৩ রবি মৌসুমে ৬টি লুপ্তপ্রায় স্থানীয় জাত নেপালী পারিজা, সাদাবোরো, ঝাঁপিবোরো, বর্গাবোরো, গোটাইরি ও কাটারীভোগ নিয়ে প্রায়োগিক গবেষণা শুরু করে যা এখনও চলমান রয়েছে।
সারণী: মৌসুমে ভিত্তিক পরীক্ষণ ও অন্তর্ভূক্ত লুপ্তপ্রায় স্থানীয় ধানজাত
উপরের সারণী বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিগত পাঁচ বছরে আমনও বোরো মৌসুম মিলিয়ে সর্বমোট ৮৮ ধরনের ধানজাত প্রায়োগিক কৃষি গবেষণায় অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। এর মধ্যে লুপ্তপ্রায় স্থানীয় জাত হলো ৭৫টি এবং বিভিন্ন দেশ থেকে সংগৃহীত বিদেশী লাইন ১৩টি। লুপ্তপ্রায় স্থানীয় জাতগুলো হলো নেপালী পারিজা, সাদাবোরো, ঝাঁপিবোরো, বর্গাবোরো, গোটাইরি, কাটারীভোগ, গুটিস্বর্ণা, রাঁধুনীপাগল, আইজং, ঝিঙ্গাশাইল, সোনালীপাইজাম, মুগুরশাইল, দেশীপাইজাম, নুইন্যা, জষ্ঠা, দলকচু, পিঁপড়ারচোখ, চিনিশাইল, লোহাজং, গাঞ্জিয়া, সোহাগ-৪, চেংগুইল, জামাই সোহাগী, পুইট্যা ইরি, জিরাশাইল, লাখাই, কাডিডিট, পারিজা, কালোবোরো, ঝাঁপিবোরো, গোলইরি, দারশাইল, বাদশাভোগ, সুবাশ, জেসমিন, পারদবালাম, চিনিকানি, বৌসোহাগী, খিরাই, কাটারীভোগ, সাগরফনা, চিনিসাগর, কালোজিরা, চিনিগুড়া, মধুশাইল, বাসমতি, গচি, আতব, বাইগুনবিচি, ভরত, বাঁশফুল, কাঁলসী, তুলসীমালা, বিন্নি, আরপারিনা, অহনা, রানাশাইল, ঝিঙ্গাশোল, শিবজটা, নীলকন্ঠ, গানজার, আজলদীঘা, রঘুশাইল, রতিশাইল, ধলাঢেপা, সুমনস্বর্ণা, রানাশাইল, রনজিৎ, পাইজাম, খৈলঝুড়ি, মাগুরশাইল, চিনিশংকর, মহিপাল, মনোয়ারশাইল, রূপকথা, চুরাইক্যা। বিভিন্ন দেশ থেকে সংগৃহীত লাইনগুলো হল DS-1,DS-2, DS-3, DS-4, DS-5, DS-6, DS-7, DS-9, PBB-407, M-394-1, M-197-3, MDZ-1-2 I MDZ-3-1
৭. গবেষণাধীন জাত বিশ্লেষণ
লুপ্তপ্রায় প্রতিটি স্থানীয় ধানজাতই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র এবং প্রতিটি জাতেই রয়েছে হরেক গুণাবলী যেমন সুগন্ধ, সর”, মোলায়েম, কাঠিন্য, আকর্ষণীয় রঙ, সুস্বাদু, পুষ্টিগুণ, আঠালোভাব, সংরক্ষণগুণ, লবণাক্ততা, খরা প্রতিরোধ ক্ষমতা, জলাবদ্ধ সহিষ্ণুতা, রোগ-পোকার আক্রমণ সহনশীলতা ও ঔষধি গুণ। এই গুণাবলীর জন্যই প্রতিটি জাতের ধান বীজই দেশের অমূল্য প্রাণসম্পদ। কোনো নির্দিষ্ট গুণ বা বৈশিষ্ট্য অপর কোনো জাতে সংকরায়নের মাধ্যমে স্থানান্তরের জন্য লুপ্তপ্রায় স্থানীয় জাত সংরক্ষণ যেমন জরুরি তেমনি জলবায়ু পরিবর্তনশীলতায় ফলনসহ অপরাপর বৈশিষ্ট্যের তুলনামূলক যাচাইয়ের জন্য ও দরকার ফসলের জাতবৈচিত্র্য। মূলত পানি সাশ্রয়ী, কম উৎপাদন ব্যয় ও স্থানীয় আবহাওয়া উপযোগি জাত নির্বাচনের প্রয়োজনেই বরেন্দ্র এলাকার লুপ্তপ্রায় স্থানীয় ধানজাতের অনুুসন্ধান, সংগ্রহ, পরীক্ষণ ও আগ্রহী কৃষকদের কাছে ধানবীজ সহজলভ্য করা জন্যই এই গবেষণা কর্ম পরিচালিত হয়।
বিভিন্ন মৌসুমের গবেষণা ফলাফলে দেখা যায়, স্থানীয় কৃষকরা চিনিশংকর, খৈলঝুড়ি, অহনা, রাঁধুনীপাগল, সোহাগ-৪, কালোজিরা, সুবাশ, জামাইসোহাগী জাতগুলো ফলন, তুলনামূলক কম সেচ, উৎপাদন খরচ, স্বাদ ও বাজার মূল্যের বিবেচনায় পছন্দ করেন। গবেষণাধীন জাতগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ফলন পাওয়া গেছে চিনিশংকর জাতে ৫.৮টন/হে যার জীবনকাল ১৫২ দিন ও প্রতি হাজার দানার ওজন ৩৫ গ্রাম আর প্যানিকেলের দৈর্ঘ্য ২৮.৫ সেমি। একই পরিচর্যায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ফলন পাওয়া গেছে খৈলঝুড়ি (৫.০৪টন/হে) জাতে। অন্যান্য জাতের ফলন হলো অহনা (৪.৪৯ টন/হে), রাঁধুনীপাগল (৪.০৯ টন/হে), সোহাগ-৪ (৪.০৯ টন/হে), কালোজিরা (৩.৬ টন/হে), সুবাশ (৩.৪টন/হে), জামাইসোহাগী (৩.৪ টন/হে)। গাছের উচ্চতা সর্বোচ্চ ১৩৬ সে.মি পাওয়া গেছে জষ্ঠা জাতে। আর সর্বনি¤œ জাত কালিজিরা গাছের উচ্চতা ৫৩ সেন্টিমিটার। জেসমিন জাতে শিকড়ের সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ২৭ সেমি দেখা গেছে। গবেষণাধীন জাতগুলোর মধ্যে সর্বনি¤œ ১০৬ দিন জীবনকাল পাওয়া গেছে জামাইসোহাগী ও দেশিপারিজা জাতে। অন্যদিকে সর্বোচ্চ ১৭৫ দিন জীবনকাল পাওয়া গেছে সোহাগ-৪ জাতে। সর্বাধিক ৩০টি কুশি পাওয়া গেছে চিনিশাইল জাতে আর চিনিকানি, সাগরফনা ও চিনিসাগর জাতসমূহে পাওয়া গেছে সর্বনি¤œ মাত্র ৮টি করে কুশি। ধান চাষে কৃষকের স্থানীয় জ্ঞানে পরিচালিত এই গবেষণায় রোগবালাই ও পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণে জৈববালাই নিবারক ব্যবহার করা হয়েছে।
প্রতি মৌসুমে প্রায়োগিক গবেষণার পরিকল্পনা শুরু হয় গ্রামীণ বৈঠকে। এই বৈঠকে আগ্রহী কৃষকদের নিয়ে তৈরি হয় পরিচালনা কমিটি যারা মূলত গবেষণা কাজটি পরিচালনা করেন। ধানজাত সংগ্রহ ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করেন কৃষক দলই। বীজ বপন থেকে শুরু করে সাপ্তাহিক ভিত্তিতে নানা পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ ও তথ্য সংগ্রহে সহায়তা করেন কৃষক দল। কৃষক দলই গবেষণা প্লটের পরিচর্যা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেন। প্রতিটি গবেষণার শেষে মাঠদিবসের দিনে কৃষকরা প্রতিটি জাতের বিশ্লেষণ করেন আবার দক্ষ কর্মীর মাধ্যমেও প্রতিটি জাতের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়।
৮. বরেন্দ্র কৃষক বীজ ব্যাংক: স্থানীয় ধান জাত সংরক্ষণে কৃষকের উদ্যোগ
লুপ্তপ্রায় স্থানীয় বীজের প্রতি কৃষকের আগ্রহ ও প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১৫ সালে রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার ১১ কিঃ মিঃ পশ্চিমে পাঁচন্দর ইউনিয়নের দুবইল গ্রামে স্থানীয় কৃষকরা তৈরি করেন বরেন্দ্র কৃষক বীজব্যাংক। এই বীজব্যাংকে বীজের পাশাপাশি রয়েছে পুরাতন দিনের নিত্য ব্যবহার্য তৈজসপত্র মাটিরপাত্র, থালা-বাসন, হাঁড়ি-পাতিল, ধাতব মুদ্রা, পুঁথি, পুরাতন বই, পত্র-পত্রিকা ও নানা শিক্ষা উপকরণ যা অতীত সময়ের নানা নিদর্শণ তুলে ধরে।
বরেন্দ্র কৃষকবীজ ব্যাংকটিতে রয়েছে এমন অনেক শস্য-ফসলের বীজ যা বরেন্দ্র এলাকায় এক সময় চাষ হলেও বর্তমান সময়ের কৃষকদের এইসব ফসল জাতের নামও জানা নেই।
বর্তমানে কৃষকবীজ ব্যাংকটিকে মোট ৮৬ ধরনের আমন, ৮ ধরনের আউশ ও ৬ ধরনের বোরো ধানের বীজ রয়েছে যা কৃষকরা প্রয়োজন অনুযায়ী নিজেদের তৈরি নিয়মের মাধ্যমে লেনদেন করছেন। বরেন্দ্র কৃষক বীজব্যাংকটি স্থানীয় কৃষকের পাশাপাশি ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, আনবিক কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ, সিসিডিবি-বাংলাদেশ, রিসার্স ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশ (রিব) ও কৃষি গবেষণা ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করে এমন অনেক উন্নয়ন সংস্থাকে লুপ্তপ্রায় স্থানীয় ধানবীজ প্রদান করে গবেষণা কাজে সহায়তা করেছে। বরেন্দ্র কৃষক বীজব্যাংকের বীজ সহায়তায় এ পর্যন্ত শাহপুর ও দুবইল গ্রামের ৯৮ জন কৃষক ২৫০ বিঘা জমিতে মসুর চাষ করেছেন। গ্রামের কৃষকদের তৈরি এই বীজব্যাংকটি প্রতিবছর নবান্নসহ নানা ধরনের গ্রামীণ উৎসব-পার্বন উৎযাপন করে থাকে। লুপ্তপ্রায় স্থানীয় জাতের বীজ সম্প্রসারণে এই ব্যাংকটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে বর্তমানে বরেন্দ্র এলাকার কৃষকের মিলন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
৯. উচ্চ বরেন্দ্র এলাকায় লুপ্তপ্রায় স্থানীয় ধান জাতের সম্প্রসারণ
বরেন্দ্র এলাকায় লুপ্তপ্রায় স্থানীয় জাতের প্রায়োগিক গবেষণার কাজটি প্রথম শুরু হয় ২০১২-১৩ সালের বোরো মৌসুমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়নের বরেন্দ্রা গ্রামে। নেপালী পারিজা, সাদাবোরো, ঝাঁপিবোরো, বর্গাবোরো, গোটাইরি ও কাটারীভোগ এই ৬টি স্থানীয় ধানজাত নিয়ে স্থানীয় কৃষকদের আগ্রহে পরীক্ষণ কাজ শুরু হয়। পরবর্তীকালে পানিসাশ্রয়, উৎপাদনসহ নানা উপযোগিতার কারণে কতিপয় ধানজাত কৃষকদের মাঝে জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং কৃষকরা প্রথমে উন্নয়ন সংস্থা বারসিক ও পরবর্তীতে নিজ উদ্যোগে বীজ ব্যাংক থেকে বীজ সংগ্রহ করে নিজেদের জমিতে চাষাবাদ শুরু করেন। এই জাতগুলোর মধ্যে চিনিশংকর, খৈলঝুড়ি, অহনা, জামাইসোহাগী, সুবাশ, কালোজিরা, রাঁধুনীপাগল, সোহাগ-৪, মাগুরশাইল, ঝিঙ্গাশাইল ও বাদশাভোগ এই ১১টি জাত ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৬টি জেলার ১৪টি উপজেলার ২৬ টি গ্রামের ৪৩৪ জন কৃষক ৩১.০৬ হেক্টর (২৩২.৯৫ বিঘা) জমিতে চাষ করেছেন। এছাড়া ২০১৪-২০১৬ এই তিন মৌসুমে আউশের জাত কালামানিক ১৫ জন কৃষক ৫৬৬ শতাংশ (১৭.১৫ বিঘা) জমিতে চাষ করেছেন।
১০. উপসংহার
শস্য-ফসল উৎপাদনের জন্য পানি একটি অতি আবশ্যকীয় উপাদান। কৃষির এই আবশ্যকীয় উপাদানটি বরেন্দ্র এলাকার কৃষকের কাছে ক্রমশই দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে। পানির স্তর ক্রমশ নি¤œগামী হওয়ায় বরেন্দ্র এলাকায় বোরো মৌসুমে পতিত জমির পরিমাণ বাড়ছে এবং প্রতিটি গভীর নলকূপের আওতাধীন জমির পরিমাণ কমছে। পাশাপাশি সেচ পানির উর্ধমূল্য এই এলাকার শস্য বিন্যাসে ইতোমধ্যে পরিবর্তন এনে একক ফসল চাষে কৃষকদের আগ্রহী করে তুুলেছে।
দেশের অন্যান্য এলাকার মতো বরেন্দ্র এলাকার কৃষকেরও প্রধান শস্য ধান। পানি সাশ্রয়ী ধানজাত নির্বাচনের এই প্রায়োগিক গবেষণার মাধ্যমে কৃষকরা লুপ্তপ্রায় স্থানীয় ধানজাতের মধ্য থেকে উপযোগি জাত নির্বাচন করে সেইসব ধানজাত চাষে যেমন আগ্রহী হয়েছেন তেমনি বোরো চাষের পরিবর্তে পানি সাশ্রয়ী রবিশস্য চাষের সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। সর্বোপরি গ্রামের কৃষকরা প্রায়োগিক গবেষণায় সম্পৃক্ত হয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়েছেন।
তথ্য সূত্র:
১. http://www.bmda.gov.bd/site/page/cc476d52-3552-4192-901d-efb7aac2e8af/%E0%A6%AA%E0%A6%9F%E0%A6%AD%E0%A7%82%E0%A6%AE%E0%A6%BF,
cÖ‡e‡ki ZvwiL: RyjvB 2, 2017, প্রবেশের তারিখ: জুলাই ২, ২০১৭
২. বীজবৈচিত্র্য রেজিস্টার, বরেন্দ্র কৃষক বীজব্যাংক, গ্রাম: দুবইল, ইউনিয়ন: পাঁচন্দর, উপজেলা: তানোর, জেলা: রাজশাহী
৩. বীজ বিনিময় রেজিস্টার, বরেন্দ্র কৃষকবীজ, গ্রাম: দুবইল, ইউনিয়ন: পাঁচন্দর, উপজেলা: তানোর, জেলা: রাজশাহী