নেত্রকোনায় কৃষকদের স্বাক্ষরতা অভিযান

:: নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমি
Untitledশিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা ছাড়া কোন দেশ ও জাতির উন্নতি হতেপারে না। তবে নানা কারণে আমাদের দেশে অনেক মানুষের কাছে শিক্ষা এখনও পৌঁছেনি। বাংলাদেশের অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক মানুষ এখনও নিরক্ষর। নিরক্ষতার কারণে তারা যেমন শিক্ষা সম্পর্কে সচেতন নয় তেমনিভাবে তাদের সন্তানদেরকে স্কুলে পাঠানোর ক্ষেত্রেও তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। ফলে এক বিরাট জনগোষ্ঠীর শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেছে এবং ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে শিক্ষাকে অবৈতনিকও করেছে তারপরও কিন্তু এখনও অনেক মানুষ নিরক্ষর রয়েছেন। বিভিন্ন কাগজ, দলিলে তারা এখনও টিপসই ব্যবহার করেন। এতে করে তারা অনেকসময় প্রতারণার শিক্ষার হন।

শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত বাংলাদেশের অন্যান্য গ্রামের মতো নেত্রকোনা জেলার নগুয়া গ্রাম অন্যতম। নেত্রকোনা শহর থেকে প্রায় ২৪ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং কেন্দুয়া শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার উত্তরে নগুয়া গ্রামটি অবস্থিত। আশুজিয়া ইউনিয়নে অর্ন্তগত এ গ্রামের মানুষ খুবই সহজ সরল। গ্রামের মানুষেরা একে অপরের সহযোগী, ঝগড়া-বিবাধ, মারামারি ও রেষারেষি নেই বললেই চলে। গোটা গ্রামটিই মনে হয় যেন এক পরিবার। তবে শিক্ষার হার কম থাকায় এ গ্রামে কী যেন অভাব বোধ করেছেন অনেকেই। গ্রামের মানুষের সাথে আলোচনায় জানা যায় যে, ১৫ থেকে ২০ বছরের উপর বয়সীদের প্রায় ৮৫ ভাগই অক্ষর জ্ঞানহীন। গ্রামটিতে কৃষকদের উদ্যেগে ২০১৪ সালের জুন মাসে গড়ে ওঠে “সবুজ শ্যামল কৃষক সংগঠন” নামে একটি কৃষক সংগঠন। এই সংগঠনের সদস্যগণ গ্রামের নিরক্ষর মানুষের জন্য অক্ষর জ্ঞান দেওয়ার এক মহৎ উদ্যোগ নেন। বারসিক তাদের এই উদ্যোগের সাথে সংহতি প্রকাশ করে। সংগঠনের সদস্যরা তাদের এই উদ্যোগকে সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য রাখাল দেবনাথের বাড়িতে “সবার জন্য শিক্ষা” নামের একটি স্কুল স্থাপন করেন। এই স্কুলে গ্রামের মোটামুটি শিক্ষিত মানুষেরা অক্ষর জ্ঞানহীন মানুষগুলোকে প্রতিদিন দু’ঘণ্টা করে পাঠদান করেন। এই স্কুলে তাই প্রতিদিন কৃষাণী, কৃষক, যুবক-যুবতী এসে জড় হন তাদের নাম, স্বাক্ষরসহ বিভিন্ন ধরনের হাতের কাজ শিখে নেন। স্কুলে আগত শিক্ষার্থীরা একে অপরকে সকল বিষয়ে সহযোগিতা করেন। এই স্কুলে শুধু শিক্ষাই দেওয়া হয় না; আলোচনা হয় কৃষি নিয়ে, কৃষি সমস্যা নিয়ে এবং সামাজিক বিভিন্ন বিষয় নিয়েও। অভিজ্ঞ কৃষক ও অন্যান্য পেশাজীবীর মানুষেরা একে অন্যকে শাকসবজি উৎপাদন, পাখা, ডালা, চালানা, কুলা, ছোকড়া ও অন্যান্য হাতের কাজ, সেলাই ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা দান করেন। এছাড়া তারা ছেলে মেয়েদের সময়মত স্কুলে পাঠনো, ঝরে পড়া ছেলে মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা পুনরায় স্কুলে পাঠানোসহ অন্যান্য সামাজিক সমস্যা নিয়েও পরস্পরের সাথে আলোচনা ও সহভাগিতা করেন। এভাবে একত্রিত হয়ে এসব মানুষেরা তাদের নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

শিক্ষার সচেতনতা তৈরির উদ্দেশে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুলে এখন গ্রামের কৃষকরা রাতে লেখাপড়া শেখা ও অন্যান্য বিষয়ে আলোচনার জন্য এই স্কুলে এসে জড় হন। তাদের এই উদ্যোগের ফলে কৃষাণ-কৃষাণীদের মধ্যে অনেকই এখন নাম ঠিকানা লিখতে ও পড়তে পারছেন। অন্যদের উৎসাহিত করার জন্য এবং নিজেদের আরও সমৃদ্ধ করার জন্য সংগঠনের সদস্যরা ছবি আঁকা, কবিতা আবৃতি, গান, নাটিকা, গজল, গীত প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। স্কুলের কার্যক্রম যাতে ব্যাহত না হয় সেজন্য সংগঠনের সদস্যরা নিজেদের উদ্যোগে এবং নিজ খরচে বিভিন্ন উপকরণাদি (ব্লাকবোর্ড, খাতা, কলম) সংগ্রহ করেন। তাদের এই উদ্যোগগুলো এলাকার ও অন্য গ্রামের শিক্ষিত ও বিভিন্ন পেশার লোকেরা স্বাগত জানায়। এভাবে তাদের সামান্য উদ্যোগে তাদের গ্রামের অনেক নিরক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ অক্ষর জ্ঞান লাভ করেছেন। এছাড়া শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে একত্রিত হওয়ার কারণে কৃষকসহ অন্যান্য পেশাজীবী মানুষের মধ্যেও আদান-প্রদান হয় জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও উপকরণ, আলোচনা হয় এবং সম্মিলিতভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করায় পরস্পরের সম্পর্কও উন্নতি হচ্ছে।

happy wheels 2

Comments