শরৎ-হেমন্ত-বসন্ত গিয়েছে, শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষাও বিরূপ
বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে অমৃত সরকার
“শরৎ-হেমন্ত-বসন্ত গিয়েছে, গ্রীষ্ম-বর্ষাও বিরূপ” মনের মাঝে আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন রাজশাহীর তানোর উপজেলার গোকুল-মোথুরা গ্রামের কৃষক সংগঠনের সদস্যরা। বর্তমান সময়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়ে আলাপকালে তাঁরা এ কথাগুলো বলেন।
এখন বৈশাখ প্রায় শেষ বাংলাদেশের ঋতুর বৈশিষ্ট্য ও মাস অনুসারে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ গ্রীষ্মকাল হওয়ার কথা বিগত বছরগুলোতে এ সময়ে প্রচন্ড গরম অনুভূত হয়। প্রচন্ড গরমে নদীনালা, পুকুর,ডোবা, খাল-বিল সব শুকিয়ে যায়। কৃষকরা ব্যস্ত থাকে পাকা ধান ঘড়ে তোলার কাছে। আবার প্রচন্ড গরমের কারণে দিনের বিকেলের দিকে শুরু হয় ঝড়। আর এ সময় এ ঝড় হয় বলে ঝড়ের নামও হয়েছে “কাল বৈশাখী”। অনেক ঝড় সংগঠিত হলেও এখানে বৃষ্টি পাতের পরিমাণ কম থাকে। কিন্তু বিগত কিছু বছর দেখা যাচ্ছে, ঝড়ের সাথে প্রচুর পরিমাণে শিলা বৃষ্টি, বজ্রপাত ও ভারী বর্ষণ। আর এ কারণে ঘটছে প্রাণহানীসহ ব্যাপক পরিমাণে ফসলহানী। এ বিষয়ে এই গ্রামের অপর কৃষক শ্রী জিতেন্দ্রনাথ সূত্রধর বলেন, “আগে দেখতাম এ সময়ে প্রচন্ড গরম থাকত আর গরমের কারণেই দিনের শেষে বিকেলে প্রচন্ড বেগে ঝড় শুরু হত সাথে সামান্য বৃষ্টিও হত। কিন্ত এখন ঝড় হওয়ার কোন সময় নেই দিনের শুরুতে, সন্ধ্যায় এমনকি মধ্যরাতেও ঝড় হচ্ছে।” তিনি আরও বলেন, “বজ্রপাতের হারও অনেক বেড়ে গেছে। এ বছর গ্রীষ্মকালে বর্ষার মত শুরু হয়েছে একটানা সারাদিন বৃষ্টি আবার গ্রীষ্মের মত গরমও অনুভব হচ্ছে না। এখনও রাতের কাথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাতে হচ্ছে। আর এ কারণে মানুষ ও গবাদি পশুর বিভিন্ন রোগের প্রার্দুভাব দেখা দিচ্ছে।”
জ্যৈষ্ঠ শেষ হলে আসে আষাঢ়-শ্রাবণ এ সময়ে ঋতু হিসেবে আসে বর্ষা। টানা বৃষ্টিপাতের কারণে এসময় সকল নদীনালা, খালবিল, পুকুর পানিতে পূর্ণ হয়ে যায়। এর মাঝেই শুরু হয় আমন ধান রোপণের প্রস্তুতি। এ ঋতু সম্পর্কে একই গ্রামের প্রবীণ কৃষাণী নিভা রানী (৫৬) বলেন, “বিগত কয়েক বছরে দেখা যাচ্ছে আষাঢ় মাসে তেমন বৃষ্টি হয় না আর এ কারণেই ফসল রোপণেও বিলম্ব হয়। মাঠে ঘাটে পানি থাকে না বলে এ সময়ে মা মাছ ডিম ছাড়তে পারে না যার কারণে আজ আমাদের মাছ বৈচিত্র্যও কমে গেছে। এখন আর বর্ষা তার রূপে নেই।”
শ্রাবণ শেষ হলে আসে ভাদ্র-আশ্বিন এ সময়ে ঋতু হিসেবে আসে শরৎ। এ সময়ে আকাশে সাদা মেঘের বেলা ভেসে বেড়ায়। বিলে বিলে ফুটে শাপলা ফুল। এ ঋতু সম্পর্কে একই গ্রামের আশা রানী (৪৭) বলেন, “এখন আর শরৎকাল প্রকৃতিতে লক্ষ্য করা যায় না। বিগত বছরগুলোতে দেখা যায় যে, এ সময়েও টানা বৃষ্টিপাত হচ্ছে। শরৎ প্রকৃতি থেকে বিলীনের পথে।”
আশ্বিন শেষ হলে আসে কার্তিক-অগ্রহায়ণ এ সময়ে ঋতু হিসেবে আসে হেমন্ত। এ সময়ে তাপমাত্রা আস্তে আস্তে কমতে থাকে। মাঠে মাঠে শুরু হয় ধান কাটার উৎসব। নবান্নও এই সময়েও হয়। এ ঋতু সম্পর্কে শ্রী রমেন্দ্রনাথ সূত্রধর(৭৩) বলেন, “হেমন্তকাল আর আগের মত নেই বিগত কয়েক বছরে দেখা যাচ্ছে এ সময়ে আগাম শীত আসছে, প্রকৃতিতে কোন শিশির লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। প্রকৃতি থেকে হারিয়েই গেছে হেমন্ত!”
অগ্রহায়ণ শেষ হলে আসে পৌষ-মাঘ মাস এ সময় ঋতু হিসেবে আসে শীত। এ সময়ে তাপমাত্রা কমে যায়। মাঠে থাকে রবিশস্যর নানা ফসল ও শাক-সবজি। শীত সম্পর্কে একই গ্রামের শ্রী রঞ্জন সূত্রধর (৫০)বলেন, “শীতের মাত্রা ও স্বায়িত্বকাল আর আগের মত নেই। এখন শীত তারাতারি আসে তারাতারি যায়। দুই একদিন আবার মাত্রাতিরিক্ত শীত অনুভূত হয়। তখন প্রবীণ ব্যক্তি ও শিশুরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়।”
মাঘ শেষ হলে আসে ফাল্গুন-চৈত্র এ সময়ে ঋতু হিসেবে আসে বসন্ত। বসন্তকে ঋতুরাজও বলা হয়। কারণ এ সময়ে গাছে গাছে বিভিন্ন রংয়ের ফুলে ভরে থাকে। তাপমাত্রাও থাকে সহনীয় পর্যায়ে। কৃষকরা ব্যস্ত থাকে চৈতালী ফসল ঘরে তোলার কাজে। ঋতুরাজ বসন্ত সম্পর্কে একই গ্রামের অঞ্জনা রানী (৪৬) বলেন, “আগে দেখেছি বসন্তকালে কোকিল ডাকে। এখন আর এই ডাক তেমন শোনা যায় না। বিগত কয়েক বছরে এ সময়েও অনেক গরম অনুভূত হয়। চলতি বছরে অবশ্য প্রচুর কুয়াশা লক্ষ্য করা গেছে। আবার মাঝে মাঝে বৃষ্টিও হয়েছে অনেক। সে কারণে রবিশস্যও নষ্ট হয়ে যায়।”
বাংলার ঋতু-বৈচিত্র্য নিয়ে আলোচনার শেষে সবাই জানান, আগে শরৎ, হেমন্ত ও বসন্ত ঋতুগুলো মানুষের খুবই পছন্দ ছিলো এবং প্রকৃতিতেও এর উপস্থিতি ব্যাপকভাবে ছিলো বলে মানুষের নামকরণও এই ঋতুগুলোর সাথে মিল রেখে রাখা হতো এখন আর তা হয় না। প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা, ফসলের ফলন, মানুষ ও গবাদি পশুর রোগ, ফসলের রোগের সাথেও আমাদের ঋতুবৈচিত্র্যর সম্পর্কে রয়েছে নিবিড়। তাই আমাদের বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির প্রভাব থেকে প্রকৃতিকে রক্ষা করতে সচেতন হওয়া প্রয়োজন এখনই।