উপমহাদেশের বিখ্যাত “ধামরাইয়ের রথযাত্রা”
মানিকগঞ্জ থেকে আব্দুর রাজ্জাক
বাংলাদেশে রথযাত্রা হিন্দুদের একটি পবিত্র উৎসব। ঢাকার উপকন্ঠে ধামরাইয়ে দেশের সর্ববৃহৎ ঐতিহ্যবাহী শ্রীশ্রী যশোমাধবের রথযাত্রা পালিত ও শুরু হয়েছে। গত শনিবার এ রথউৎসব ও মাসব্যাপী মেলার উদ্বোধন করেন স্থানীয় এমপি এম.এ মালেক ।
জানা যায়, প্রায় ৪০০ বছর ধরে ধামরাইয়ে ঐতিহ্যবাহী যশোমাধবের রথযাত্রা উৎসব পালিত হয়ে আসছে। এটি উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন রথযাত্রা, যা শুরু হয়েছিল বাংলা ১০৭৯ সালে। শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে প্রতিবছর রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। ৯ দিন পর উল্টো রথ। আর এ উপলক্ষে এই ৯ দিন মেলা বসে। দেশের বিভিন্ন স্থানে রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় সেই সঙ্গে মেলাও। তবে দেশের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী ও বড় রথযাত্রা এবং রথের মেলা বসে ধামরাইয়ে। ঢাকার উপকণ্ঠে ধামরাইয়ে এ রথযাত্রা যশোমাধবের রথযাত্রা নামে উপমহাদেশে বিখ্যাত।
আনুষ্ঠানিক উদ্ভোধন
ধামরাই যশোমাধব মন্দির ও রথ পরিচালনা কমিটির সভাপতি মেজর জেনারেল (অবঃ) জীবন কানাই দাসের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন ঢাকা জেলা উত্তর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) সাইদুর রহমান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সাভার সার্কেল) মো. তাহমিদুল ইসলাম। বিকেল সাড়ে ৬টায় মাধব মন্দির থেকে মাধব বিগ্রহসহ অন্য বিগ্রহ গুলো নিয়ে এস রথখোলায় রথের ওপর মূর্তিগুলো স্থাপন করা হয়। আগামী ২২ জুলাই অনুষ্ঠিত হবে উল্টো রথযাত্রা।
রথ মেলায় যা যা থাকে
মেলায় প্রতিবছরই থাকে দেশবিখ্যাত সার্কাস দল, নাগরদোলা, পুতুল নাচ, চুড়ি নিয়ে হাজির হয় বেদেনীরা, মৃত্যুকূপে মোটরসাইকেল কাঠের বৃত্তের মধ্যে ঘোরানো হয়, শিশুদের জন্য কাঠের, বাঁশের, মাটির খেলনা, কুটির শিল্প, তৈজসপত্র, ফার্নিচার ও খাদ্যদ্রব্য যেমনথ খই, মুড়ি-মুড়কিসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্যের পসরা বসে মেলায়। হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্ম কাহিনী থেকে মেলার উৎপত্তি। তবে ধর্মীয় দিক ছাড়া উৎসব কার্যত সর্বজনীন রূপ লাভ করে। রথটানার সময় চারদিক থেকে উলুধ্বনি দিয়ে ভক্তদের ছিটানো চিনি, কলা ছাড়াও বিভিন্ন ফল বৃষ্টির মতো পড়তে থাকে। রথের গমনাগমন দেখতে সব ধর্মের হাজার হাজার লোকের সমাগম ঘটে ধামরাইয়ে।
ধামরাই জগন্নাথ রথের ইতিহাস
ধামরাইয়ের রথযাত্রার ইতিহাস বেশ পুরোনো। বাংলা ১০৭৯ সাল থেকে দীর্ঘ ৩৩৮ বছর ধরে ধামরাইয়ের রথযাত্রা ও রথমেলা উৎসব পালিত হয়ে আসছে নানান আঙ্গিকে। কিভাবে কালের পরিবর্তনে কখন এই বাঁশের রথটি কাঠের রথে পরিণত হয় তার সঠিক ইতিহাস পাওয়া যায়নি। বাঁশের রথের পর বাংলা ১২০৪ সাল থেকে ১৩৪৪ সাল পর্যন্ত মানিকগঞ্জের বালিয়াটির জমিদাররা বংশানুক্রমে এখানে পর পর চারটি রথ তৈরি করেন। ১৩৪৪ সালে একবছর সময় ধরে যে রথটি তৈরি করা হয়, তার ঠিকাদার ছিলেন নারায়ণগঞ্জের সূর্য নারায়ণ সাহা। ধামরাই, কালিয়াকৈর, সাটুরিয়া, সিঙ্গাইর থানার বিভিন্ন কাঠশিল্পী যৌথভাবে নির্মাণ কাজে অংশগ্রহণ করে সেসময় প্রায় ৬০ ফুট উচ্চতায় রথটি তৈরি করেন। রথটি ছিল তিনতলা। সময়ের পরিক্রমায় একসময় নষ্ট হয়ে যায় সেই তিনতলা বিশাল রথ।
১৩৫০ (বাংলা) সালে জমিদারি প্রথার বিলুপ্তি ঘটার পর টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুরের দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার সহযোগিতায় ছোট রথ তৈরি করে আবার শুরু হয় ধামরাইয়ের ঐতিহ্যবাহী শ্রী শ্রী যশোমাধবের রথযাত্রা। সেই ছোট আকারের ৩০ ফুট উচ্চতার রথ তৈরি করে উৎসব পালন হয়ে আসছিল পূর্বের উৎসব আয়োজনেই। রথ ছোট হলেও রথটানার একই আনন্দে উদ্বেলিত ছিল সার্বজনীনভাবে সবাই। সেই ঐতিহ্যম-িত রথটি ধামরাইয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদাররা পুড়িয়ে দেয়। নষ্ট করে ফেলে রথযাত্রার সমস্ত আয়োজন। কিন্তু উৎসব ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য থেকে রথযাত্রা উৎসবকে বিছিন্ন করতে পারেনি তারা। পরবর্তীতে ছোট একটি রথ তৈরি করে তাতেই চলছিল সব আয়োজন।
বর্তমানে রথের অবস্থা
২০০৬ সালের রথযাত্রা অনুষ্ঠানে এসে ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনার বীণা সিক্রি ভারত সরকারের অনুদানে বড় আকারের একটি রথ নির্মাণ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নতুন একটি রথ নির্মাণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের ইউডিসি কেলভিন টেকনো টাচ নামের একটি প্রতিষ্ঠান রথটি নির্মাণে সার্বিক দায়িত্ব পালন করে। নকশা তৈরিতে সহায়তা করে সিইসি ইন্ডিয়া নামের ভারতের একটি প্রতিষ্ঠান। রথটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে সাড়ে ৭৮ লাখ টাকা। ৪০ জন শিল্পী ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে নিরলসভাবে কাজ করে ৩৭ ফুট উচ্চতা ও ২০ফুট প্রস্থের কারুকার্যখচিত নতুন রথটি নির্মাণ করেন। লোহার খাঁচার ওপর সেগুন ও চাম্বল কাঠ বসিয়ে খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে আকর্ষণীয় সব শৈল্পিক নিদর্শন। এতে রয়েছে লোহার তৈরি ১৫টি চাকা। রথের সামনে রয়েছে কাঠের তৈরি দুটি ঘোড়া ও সারথি।এ ছাড়া রথের বিভিন্ন ধাপে প্রকোষ্ঠের মাঝে স্থাপন করা হয়েছে কাঠের তৈরি দেব-দেবীর মূর্তি।
বারো মাসে তেরো পার্বণের এই বাংলাদেশে বছরব্যাপী উৎসবের কোনো কমতি নেই। এমনই এক লোকারণ্যের উৎসব- রথ উৎসব। এ রথ- মেলা পারস্পরিক মেলবন্ধন ও সার্বজনীনতার সুপ্রাচীন প্রতীক।