মূলা ষষ্ঠী পূজায় শুভ সূচী ও মঙ্গল কামনা
চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু
১৩ ডিসেম্বর ২০১৮। বৃহস্পতিবার দুপুরে পাবনার চাটমোহরের বিলচলন ইউনিয়নের কুমারগাড়া গ্রামে পথের পাশের কালি মন্দিরের জটাধারী বটতলায় বারো নারী ব্যস্ত ছিলেন মূলা ষষ্ঠী পূজার আনুষ্ঠানিকতায়। পূজার আনুষ্ঠানিকতায় জৌলুশ না থাকলেও সমবেত উলুধ্বনী ইথারে যোগ করছিল ভিন্ন মাত্রা। এ পথে যাবার সময় কর্ণ কুহরে উলুধ্বনীর শব্দ মনযোগ আকর্ষণ করে।
এ গ্রামে দীর্ঘদিন যাবত বসবাস করে আসছেন প্রায় সত্তর ঘর সনাতন ধর্মাবলম্বী পরিবার। এসব পরিবারের অধিকাংশই অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল নয়। কেউ মৎসজীবী, কেউ জমা জমি চাষ করেন, কেউবা কৃষি শ্রম বিক্রি করেন। উৎসাবাদীতে জৌলুশ না থাকলেও এখনো তারা পালন করে আসছেন সনাতন ধর্মের নানা আচার। বেশকিছু ষষ্ঠীব্রত পালন করতেও দেখা যায় তাদের। এর মধ্যে মূলা ষষ্ঠী অন্যতম। অশোকা ষষ্ঠী, লণ্ঠন ষষ্টী, জামাই ষষ্ঠী, পাটাই ষষ্ঠী, শীতল ষষ্ঠী ও পালন করতে দেখা যায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের। মূলা ষষ্ঠী পূজার অর্ঘ উপাচার হিসেবে উদ্ভিদ ফল ফসলের বিচিত্র ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। কুমারগাড়া ছাড়াও চাটমোহরের মূলগ্রামসহ কয়েকটি গ্রামে প্রতিবছর মূলা ষষ্ঠী পূজার আয়োজন করা হয়।
বট গাছের চার পাশে গোল হয়ে বসেছেন পূজারীরা। মাঝখানে কলার মাজ পাতার উপর গাই বাছুর ও পাটায় পেষা আতপ চাল। সামনে দুধ, আপেল, কমলা, বেলপাতা, বাতাবী লেবু, শসা, কলা, আঙ্গুর, পেয়ারা, বাতাসা, তুলশী পাতা, জবা ফুল, শিউলী ফুল, দূর্বা ঘাস, মূলা ও ধানের শিষের স্তুপ। চারপাশে গোল হয়ে বসা উষা রাণী, আদুরী, সপ্তমী রাণী, মাতঙ্গিনী রাণী, বীনা রাণী, বানী, মঞ্জু হালদার, পুতুলী হালদার, কৃষ্ণা হালদার, শংকরী রাণী ও বনি রাণী। ঘণ্টা বাজানোর সাথে সাথে শুরু হয় পূজার মূল আনুষ্ঠানিকতা। উলুধ্বনীতে মুখরিত হয় মন্দির প্রাঙ্গণ। থেমে থেমে মূলা ও ধানের স্তুপে সবাই যার যার সাথে নিয়ে আসা পূজার উপকরণ মায়ের উদ্দেশ্যে রাখছিলেন। সবগুলো উপকরণ দেবার পর অপাক্তেয় অংশ তারা শাড়ির আচলে করে নিয়ে সাড়িবদ্ধভাবে বাড়ির পাশর্^বর্তী বড়াল নদীর ঘাটে গিয়ে জলে বিসর্জন দেন।
বড়াল নদীর পাশ^বর্তী কালী মন্দিরের উত্তর পাশে এ পূজা চলা কালে গোপাল চন্দ্র হালদার গুটু বলেন, “প্রতিবছর এই ষষ্ঠী ব্রতের আয়োজন করে আমাদের গৃহবধুরা। প্রত্যেক পূজারী পূজার জন্য ৬টি করে মূলা, ৬টি করে ধানের শীষসহ অন্যান্য উপকরণ এনেছেন। শুভ সূচী ও মঙ্গল কামনায় আমরা এ পূজা দিয়ে থাকি।’
এ পূজা সম্পর্কে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের খাঁনপুকুর এলাকার প্রিয়াঙ্কা সরকার জানান, বিশেষত কার্তিক অগ্রহায়ণ মাসে যখন নতুন ফসল ঘরে ওঠে তখন মূলা ষষ্ঠী পূজার আয়োজন করা হয়। যাদের সন্তান হয়না সে সকল মহিলা সন্তান লাভের আশায় এবং যাদের সন্তান আছে তারা সন্তানের মঙ্গলার্থে মূলত ষষ্ঠী পূজা করে থাকেন। ভারতের মালদহে এ পূজার আয়োজন বেশি হয়। কথিত আছে, মালদহের বেহুলা নদীর পাড়ে এক সময় লোক বসতি ছিল না। এলাকাটি জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। সেখানে বেহুলা মাকে নিয়ে জুয়া খেলা হয়েছিল। মা মনসার আশির্বাদ লাভের আশায় এখনো সেখানে ষষ্ঠী পূজা হয়ে থাকে। এ উপলক্ষে মালদহের বেহুলা নদী পারের নেউড়ি এলাকায় মেলা বসে। আনন্দ উপভোগের জন্য পূজার বিশেষ এ দিনে এখনো সেখানে ছেলে মেয়েসহ বিভিন্ন বয়সী মানুষ জুয়া খেলে থাকেন। মায়ের কৃপা প্রার্থনায় মাকে হরেক রকম খাবার দেয়া হয়। পূজা শেষে অপাক্তেয় অংশ নদীতে বিসর্জন দেয়া হয়।