আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম…
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
কুয়াশা ঘেরা শীতের সকালে মায়েরা উঠোনে চুলা জ্বালিয়ে বসতেন। তৈরি করতেন নানা রকমের পিঠা। আর চারপাশে ভিড় করে থাকতো পরিবারে সব বয়সী সদস্যরা। পাকন পিঠা, ফুল পিঠা, নকশা পিঠা, সাঁচের পিঠা, চিতই পিঠা, দুধপুলি, পাটিসাপটা আরো কত্ত বাহারি নাম! পেট পুরে পিঠা খেয়ে যে যার কাজে চলে যেতো। ছোটরা কিছুক্ষণ পর আবার আসতো মায়ের কাছে। যদি আরো কিছু অবশিষ্ট থাকে সেই আশায়। হাতে নিয়েই আবার দৌড়। তারটা দেখে অন্যরাও আসতো। মা জানতেন, তাঁর সন্তানরা বার বার আসবে এই পিঠা খেতে। তাই নিজে না খেয়ে বা কম খেয়ে হলেও কিছু তুলে রাখতেন ওদের জন্য। আর বাড়িতে নতুন জামাই বা অতিথি এলে তো কোনো কথাই ছিল না। সারাদিন শুধু পিঠা খাওয়া।
এটা ছিল বেশ কয়েক বছর আগের দৃশ্য। এখন তেমন দৃশ্য চোখে পড়ে কই? নতুন জামাই এলেও সেমাই, নুডুলস এর হাঁড়ি চাপে চুলায়। এই আধুনিক খাবার জামাইয়ের পাতে না দিলে শ্বাশুড়ির নাকি মান থাকে না। ছেলেমেয়েরাও চিপ্স এর প্যাকেটে অভ্যস্ত। অতিথিপরায়ণ বাংলার মা বোনেরা নকশা করা পিঠা বানানো প্রায় ভুলতেই বসেছেন।
গ্রাম বাংলার নিজস্ব চর্চা, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতেই আয়োজন হয়েছিল বিজয়মেলা ও পিঠা উৎসবের। নেত্রকোণা জেলার লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের শিক্ষা, সংস্কৃতি, পরিবেশ ও বৈচিত্র্য রক্ষা কমিটির উদ্যোগে দিনব্যাপি এই অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ ছিল পিঠার স্টল। ইউনিয়নের আশপাশের প্রায় সাতটি গ্রামের ১৫জন নারী বিভিন্ন রকমের পিঠা তৈরি করে নিয়ে আসে।
ইউনিয়নের প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা মো. ইনামুল হক এর হাত দিয়েই অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা হয়। এছাড়া এই অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন বারসিক’র সংগঠন ব্যবস্থাপনা, পরিবীক্ষণ ও সহায়ক কমিটির আহবায়ক সায়েদ আহাম্মদ খান বাচ্চু, লক্ষ্মীগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এখলাছুর রহমান, ইউনিয়ন পরিষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান, মেম্বার, এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গসহ সকল শ্রেণি পেশার মানুষ।
উদ্বোধন পর্বে বর্ষীয়ান মুক্তিযোদ্ধা ইনামূল হক বলেন, ‘আমরা এখন পিঠা খাইনা, এত জাতের পিঠা এখনকার বৌয়েরা বানাতে পারেনা। ছোট বেলায় আমার মা কত যত্ন করে পিঠা বানাতেন। কয়েকদিন চলতো বাড়িতে পিঠার উৎসব। সেই দিনগুলো এখনো চোখে ভাসে। মনে হয় আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম। খাওয়ার মজা ছিল, খাওয়াতেও মজা ছিল। পাড়া প্রতিবেশিদের নিয়ে পিঠা খেতাম। সেই সব দিন আবার আসবে কিনা জানি না। তবে আজকের অনুষ্ঠানের পিঠা দেখে মনে হচ্ছে আমি আমার ছোট বেলায় ফিরে গেছি।’
ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই নারীগণ দল বেঁেধ পিঠার পসরা নিয়ে আসেন। তাঁদের ঘিরে ছোট শিশুরা। মায়ের সাথে তারাও এসেছে পিঠা উৎসবে। রাত জেগে নারীরা ভাঁপা পিঠা, ফুল পিঠা, ম্যাড়া পিঠা, চিরুনি পিঠা, নকশী পিঠা, ধামা পিঠা, কাটা পিঠা, মসলা পিঠা, চিতই পিঠা, কলার পিঠা আরো কত পিঠা তৈরি করেছেন। তাই নিয়ে চলে আসেন ল²ীগঞ্জ বাজারের অগ্রগামী কিণ্ডার গার্টেন এর মাঠে। দেশাত্মবোধক গানের মধ্য দিয়েই উৎসবের শুরু।
দলে দলে লোকজন আসতে থাকে মেলা প্রাঙ্গণে। জাতি, ধর্ম, পেশা সকলের কোলাহলে মুখরিত অনুষ্ঠানস্থল। আর মা-বোনেরা পিঠা দিয়ে অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত। দিনভর চলে পিঠা খাওয়া। পাশাপাশি চলে স্থানীয় শিল্পিদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক আয়োজন। দিনশেষে পিঠা প্রস্তুতকারী সকলকেই পুরস্কৃত করা হয়।
জাতি, ধর্ম, শ্রেণি, পেশার সকল মানুষকে এক দৃষ্টিতে দেখা এবং সকলকে নিয়ে পরিবেশ ও সমাজ উন্নয়নের উদ্যেশ্যে ২০১৯ সালের গোড়ার দিকে শিক্ষা, সংস্কৃতি, পরিবেশ ও বৈচিত্র্য রক্ষা কমিটির পথ চলা শুরু হয়। প্রতি মাসেই তাঁরা বিভিন্ন বিষয়কে সামনে রেখে কাজ করেন। এটিও ছিল তারই ধারাবাহিকতা। মূলত নারীদের জ্ঞানকে সম্মান জানানো, নতুন প্রজন্মের সামনে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে তুলে ধরা এবং পরিবেশসম্মত চর্চায় সকলকে উদ্বুদ্ধ করতে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানে আগত নারীরা উৎসাহের সাথে এখানে সারাদিন কাটায়। নির্ঘুম রাত্রির কোনো ক্লান্তি ছিলনা তাদের চোখেমুখে। কারণ এধরণের আয়োজন এখানে আর কখনো হয়নি। একদিনের জন্য হলেও তাঁরা মন খুলে আনন্দ করতে পেরেছে। নিজ গণ্ডি পেরিয়ে উন্মুক্ত পরিবেশে মনের ভারটা হালকা করতে পেরেছে। এই একটা ব্যতিক্রমী দিন সারা বছরের খোরাক হয়ে থাকবে বলে তাঁদের বিশ্বাস।