সুস্থ সাংস্কৃতির চর্চাই মানবিক সমাজ গড়ার হাতিয়ার
নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা
‘সুস্থ সাংস্কৃতির র্চচাই মানবিক সমাজ গড়ার হাতিয়ার’ এ সত্যকে ধারণ করেই নেত্রকোনা জেলা সিংহেরবাংলা ইউনিয়নের বাংলা গ্রামে গঠিত হয় ‘আদি সাংস্কৃতিক সংগঠন’। সংগঠনটি এলাকার সংগঠনটি দীর্ঘদিন ধরে সামাজিক অসঙ্গতি, জাতিগত বিভেদ, মানুষে-মানুষে বৈষম্য গ্রামীণ জীবনধারা, গ্রামীণ সংস্কৃতির সংরক্ষক, প্রজন্ম বিভেদ, প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষায় প্রচারণামূলক কার্যক্রম করে আসছে।
সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের সাথে এলাকার সংস্কৃতিমনা যুব ও শিক্ষার্থীদের যুক্ত করার উদ্দেশ্যে সংগঠনের উদ্যোগে বাংলা বাজারে ‘শিক্ষা ও সাংস্কিৃতক চর্চা কেন্দ্র’ নামে একটি গড়ে তোলা হয়েছে। মূলতঃ এলাকার বাউল শিল্পী, পালাকার ও নাট্যাভিনেতারা যাতে নিয়মিত বাউল গান, পালাগান ও নাট্য চর্চা করতে পারে সেই লক্ষ্যে কেন্দ্রটি নাট্যাভিনেতা ও ‘আদি সাংস্কৃতিক সংগঠন’ এর সভাপতি বাবুল মিয়ার উদ্যোগে এবং বারসিক নেত্রকোনার সার্বিক সহযোগিতায় গড়ে তোলা হয়। কেন্দ্রটিতে সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উপকরণ ও বাদ্যযন্ত্র সংরক্ষণ করা হয়। এলাকার সাংস্কৃতিমনা ব্যক্তির জন্য কেন্দ্রটি উন্মূক্ত।
গত ১০ মার্চ ২০২০ তারিখ মুজিববর্ষ উপলক্ষে সংগঠনের উদ্যোগে কেন্দ্রটিতে এক আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অবদানের জন্য এলাকার প্রবীণ বাউলদের সম্মাননা প্রদান করা হয়। আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নেত্রকোনার বিভিন্ন এলাকার বাউল শিল্পী, স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসা বিভিন্ন বয়সের ও পেশার প্রায় শতাধিক সাংস্কৃতিকমনা ব্যক্তি।
অনুষ্ঠানের শুরুতে সংগঠনের সভা প্রধান মোঃ বাবুল মিয়া শেখ মুজিবুর রহমানের দেশ প্রেম ও পরিবেশবান্ধব কার্যক্রমগুলো নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি সকল সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদেরকে মুজিববর্ষে সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্যমে সকল সামাজিক উন্নয়নে সকল বাধাসমূহ দূর করে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাওয়া আহবান জানান। তিনি তার বক্তব্যে বলেন, ‘আজ আমাদের এলাকার গুণী প্রবীণ বাউল শিল্পীকে সম্মাননা প্রদানের মাধ্যমে আগামী প্রজন্মকে তাঁর লিখা গানগুলো সংগ্রহ করার দায়িত্ব দিতে চাই, আমরা যা পারিনি তারা যেন সেই দায়িত্বটি হাতে তুলে নেয়। সংগঠনের উদ্যোগে বাউল আব্দুল কাদির এর লেখা গানগুলো সংগ্রহ করে লিখিত রূপ দিয়ে কেন্দ্রটিতে সংরক্ষণ করা হবে।’
এ সম্মাননা প্রদান সম্পর্কে উপস্থিত স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি (কমিশনার) সালমা বেগম বলেন, ‘আমি ধন্যবাদ জানাছি আদি সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্য ও বারসিককে যারা যৌথভাবে আজকে আমাদের এলাকার একজন গুণী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে সম্মাননা প্রদান করেছেন। যার সাথে আমার দীর্ঘ দিনে পরিচয়, কিন্তু তিনি যে এত বড় একজন গুণীজন সে বিষয়টি আমার যেমন জানা ছিলনা, তেমনি আমাদের এলাকার অনেকেই বিষয়টি জানতেন না। আমি আমার স্থানীয় সরকার পরিষদে বিষয়টি তুলে ধরবো।’
বারসিক কর্মকর্তা খাদিজ আক্তার লিটা তার বক্তব্যে বলেন, ‘বারসিক নেত্রকোনার বিভিন্ন এলাকার প্রান্তিক বাউল দল ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর জন্য সরকারি/বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রদত্ত সেবা ও পরিসেবাসমূহ পেতে এবং তাদের নিয়মিত চর্চায় দলগুলোকে শক্তিশালীকরণে সভা, প্রশিক্ষাণ, অভিজ্ঞতা বিনিময় সফরের আয়োজন, সাংস্কৃতিক চর্চায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উপকরণ দিয়ে (যাদ্যযন্ত্র, পোষাক, নাটক ও গান রচনা উৎসাহিতকরণ) এবং সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সাংস্কৃতিক প্রচারাভিযানের আয়োজনে সহযোগি সংস্থা হিসেবে কাজ করে আসছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আজকে সিংহেরবাংলা আদি সাংস্কৃতিক সংগঠন এর ‘শিক্ষা ও সাংস্কিৃতক চর্চা কেন্দ্র’ গড়ে তোলার উদ্যোগটি সত্যি প্রশংসনীয়। বারসিক আশা করে সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমে বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা একটি সুস্থ, সুন্দর, শান্তিপূর্ণ ও সকলের জন্য একটি নিরাপদ সমাজ গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করবে।’
আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে আদি সাংস্কৃতিক সংগঠনের উদ্যোগে সিংহেরবাংলা ইউনিয়নের সৈয়দপুর গ্রামের প্রায় ৯০ বছর বয়স্ক প্রবীণ বাউল আব্দুল কাদির বাউলকে (যিনি এলাকায় হিরণ মুন্সী নামে পরিচিত) প্রায় শতাধিক বাইল গান রচনার জন্য সম্মানিত করা হয়। শতাধিক বাউল গান রচনা করলেও তাঁর লেখা গানগুলো কোথাও লিখিত আকারে সংগ্রহ করা হয়নি। তাঁর গানগুলো এলাকার বাউলদের নিয়মিত চর্চা ও পরিবেশনের মাধ্যমে বাউলদের দ্বারাই সংরক্ষিত হয়ে আসছে।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে উপস্থিত বাউল শিল্পীরা প্রবীণ বাউল আব্দুল কাদির (হিরণ মুন্সী) লেখা গানগুলো পরিবেশন করেন। স্থানীয় কৃষ্ণ গোবিন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় এর শিক্ষার্থী প্রশান্ত চক্রবর্তী (বিশেষভাবে সক্ষম) অন্যান্য বাউলদের সাথে বাউল গান পরিবেশন করেন।
একটি সুন্দর সমাজ বির্নিমাণে সুন্দর মানসিকতার প্রয়োজন। সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমেই একটি সুন্দর ও মানবিক সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব। আমাদের চারপাশে ছোট ছোট সাংস্কৃতিক দলগুলো যাতে তাদের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম নিয়মিত চালিয়ে যেতে পারে সেজন্য আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। কাজ করতে হবে হাতে হাত রেখে। আধুনিকতার নামে আমরা যেন আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও আমাদের অস্তিত্বকে ভুলে না যাই। আমাদের সামান্য উদ্যোগের অভাবে আমাদের প্রবীণ গুণীজনদের জ্ঞান যারা আমাদের সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে মানবকি সমাজ গড়ে তোলার জন্য রাতের পর রাত জেগে রচনা করে গেছেন সে মহামূল্যবান সম্পদগুলো যেন হারিয়ে না যায়। তাই আসুন অমরা সকলে মিলে আমাদের ঐতিহ্যকে রক্ষা করি, গড়ে তুলি একটি বৈচিত্র্যময় বহুত্ববাদী সমাজ।