হার না মানা সনি আক্তারের গল্প
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
সব মানুষ এক রকম ভাগ্য নিয়ে জন্মায়না। কেউ দরিদ্র ঘরে জন্ম নিয়েও নিজের একান্ত চেষ্টায় নিজের অবস্থানের পরিবর্তন করতে পারে। ইচ্ছা আর প্রচেষ্টা থাকলে যে কেউ সাফল্যের শিখরে পৌঁছাতে পারে। এরকমই একজন লক্ষীগঞ্জ ইউনিয়নের সুলতানগাতী গ্রামের সনি আক্তার। কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও সে আজ নিজের চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত।
সাত ভাইয়ের এক বোন হয়ে জন্মগ্রহণ করে সনি আক্তার। বাবা ছিলেন একজন কৃষক। তবে জমিজমা বেশ ভালোই ছিল। তেমন অভাবে চলতে হয়নি। সনি আক্তারের ভাইদের পড়ালেখার প্রতি তেমন আগ্রহ ছিলনা। তাই তারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে আর পড়ালেখা করেননি। কিন্তু সনি ছিল ব্যতিক্রম। ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ায় অত্যন্ত আগ্রহ ছিল তার। তাই স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয় তাকে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়া শেষ করে সনি ভর্তি হয় নেত্রকোণা জেলার ব্যতিক্রমী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হাজী ফয়েজ উদ্দিন আকন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ে। ছোটবেলা থেকেই একটু চঞ্চল প্রকৃতির ছিল সে। গাছে চড়া, সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানো সবই শিখে নিয়েছিল সমবয়সীদের কাছ থেকে। উক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হবার পর এই অভ্যাসগুলো আরো শানিত হয়। কারণ এই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানে ছেলেমেয়ে কোনো ভেদাভেদ নেই বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চাইতে কিছুটা ভিন্ন হয়ে থাকে। সবাই সকল ধরণের আয়োজনে অংশ নিতে পারে। যেমন ছেলেরা সাইকেল চালাবে, এটা আমরা দেখে অভ্যস্ত। আবার মেয়েরা মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করবে। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানে ছেলেরা মেয়ে সেজে অভিনয় করে। অন্যদিকে মেয়েরা সাইকেল চালানো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে।
বারসিক’র সহযোগিতায় গড়ে উঠা নকশী কাঁথা যুব সংগঠনের সক্রিয় সদস্য ছিল সনি। নিজের যেহেতু বিভিন্ন খেলাধূলায় আগ্রহ ছিল তাই গ্রামের অন্যান্য নারীদেরকেও যুক্ত করে খেলাধূলা ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করতো। তার উৎসাহেই গ্রামের নারীরা ভিন্ন রকম আনন্দ করার সুযোগ পেতো।
সনি আক্তারের যেহেতু ছোটবেলা থেকেই এধরণের কাজে আগ্রহ ছিল তাই স্কুলের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় প্রতিবছর সে অংশগ্রহণ করে এবং পুরষ্কার অর্জন করে। পাশাপাশি খুব ভালোভাবে লেখাপড়াও চালিয়ে যায়। একটু ডানপিটে স্বভাবের কারণে প্রতিবেশিরা তাকে খুব ভালোবাসতো। এভাবেই চলছিল তার দিনকাল। কিন্তু হঠাৎ করেই তার মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। ভাইয়েরা বিয়ে করে নিজের সংসার নিয়ে আলাদা থাকে। তাই মায়ের দেখাশুনা তাকেই করতে হতো। একদিকে অসুস্থ মায়ের যতœ, সংসারের কাজ, পাশাপাশি পড়াশুনাও করে যাচ্ছিল। তার মায়ের অনেক চিকিৎসা করানোর পরও পুরোপুরি সুস্থ হয়না, মানসিক রোগীতে পরিণত হয়ে যান। কখনো ভালো থাকেন আবার কখনো পাগলের মাতো আচরণ করেন।
মায়ের চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে সনির বাবার অনেক জমি বিক্রি করতে হয়েছে। তাছাড়া এর আগেই ছয় ছেলের মাঝে ভাগ করে দেয়ার ফলে জমি আর নেই বললেই চলে। তাই সংসার চালানোর জন্য সনি আক্তারের বাবা দিন মজুরের কাজ বেছে নেয়। সংসারের খরচ, অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসা এগুলো মেটাতে গিয়ে সনির বৃদ্ধ বাবা আর পেরে উঠছিলেন না। ভাইয়েরাও সনি বা তার মায়ের কোনো খোঁজ খবর নিতোনা। যে কারণে অনেকটা বাধ্য হয়েই সনিকে নিজের পড়ার খরচ চালানোর চেষ্টা করতে হয়।
নিজের লেখাপড়ার পাশাপাশি স্থানীয় একটি কি-ার গার্টেন স্কুলে পড়াতে শুরু করে। ততোদিনে সে এইচএসসিতে পড়ছে। আর তার অসুস্থ মা আরো অসুস্থ হতে থাকেন। কোনো চিকিৎসাতেই কাজ হচ্ছিলনা। ডাক্তার, কবিরাজ কোনো কিছুই বাদ রাখেনি। যে যা বলেছে, সেভাবেই চিকিৎসা করিয়ে প্রায় সর্বশান্ত হয়ে যায় সনির পরিবার। সে সময় সনির লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে যায়। তবুও সে হাল ছাড়েনি। অনেক কষ্ট করে এইচএসসি পরীক্ষা দেয়।
টাকার অভাবে সনির মা’র চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যায়। কারণ বসত ভিটাটুকু ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট ছিলনা তাদের। বাবাও এতোটা বৃদ্ধ হয়ে যায় যে দিনমজুরীর কাজও করতে পারেনা। সনি টিউশনি করে, স্কুলে পড়িয়ে কোনো রকমে সংসার চালাতে থাকে। পাশাপাশি চাকরির চেষ্টা করে। কোনোভাবে জানতে পারে বিজিবিতে লোক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। সে একাই নেত্রকোণা এসে আবেদন ফরম যোগার করে ও জমা দেয়। প্রাথমিক বাছাইয়ে উচ্চতায় সে নির্বাচিত হয়।
এরপর শুরু হয় শারিরীক কসরৎ এর পরীক্ষা। সেখানে সাঁতার ও সাইকেল চালানো প্রতিযোগিতায় প্রায় ৮শত অংশগ্রহণকারীর মধ্যে সে প্রথম হয়। এরপর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সে সফলতার সাথে সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত হয় এবং ছয় মাসের প্রশিক্ষণে চট্টগ্রাম চলে যায়। চাকরিতে যোগ দেয়ার একটাই উদ্দেশ্য ছিল তার, চিকিৎসা করে মাকে সুস্থ করে তোলা। পড়াশুনাও করতে চেয়েছিল কিন্তু মায়ের অসুস্থতার কারণে সেই ইচ্ছেটা মনের ভিতর চেপে রেখে চাকরিতে চলে যায়।
প্রশিক্ষণ করতে এসে অনেকেই শারীরিক পরিশ্রম সহ্য করতে পারছিলনা। কিন্তু সনি মনোবল শক্ত রেখে সকল কষ্ট সহ্য করেছিল। শুধুমাত্র তার মা সুস্থ হবে বলে। যত কষ্টই হোকনা কেন টাকা রোজগার করে মাকে সুস্থ করাই ছিল তার একমাত্র ইচ্ছা। প্রশিক্ষণে এ থাকা অবস্থায় মা’র সাথে প্রতিদিন কথা বলতেও পারেনি। কারণ অনেক নিয়ম শৃংখলার মধ্য দিয়ে তাকে চলতে হতো। এরই মাঝে কখনো মা সুস্থ থাকতেন আবার কখনো খুবই অসুস্থ হয়ে যেতেন। সব কিছু মেনে নিয়ে সনি শুধু বাড়ি ফেরার দিন গুণতে থাকে।
কিন্তু প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার ছয় দিন আগেই তার মা হঠাৎ করেই মারা যান। এই খবর শুনে সে চট্টগ্রাম থেকে বিশেষ ছুটিতে বাড়ি আসে। টাকা উপার্জন করে মায়ের চিকিৎসা করা আর হলোনা। তার উপার্জনের টাকা মা দেখে যেতে পারলেন না। চারদিন বাড়িতে থেকে আবার ফিরে গিয়ে ট্রেণিং শেষে ছুটিতে বাড়ি আসে। ছয় মাসের শিক্ষানবীশকালীন ৪০ হাজার টাকা যেদিন হাতে পায় সেদিন সে সারাদিন কেঁদেছে। এত টাকা দিয়ে এখন সে কি করবে? যার জন্য টাকা রোজগার করতে গিয়েছিল সে ই তো বেঁচে নেই। সে কেঁদে কেঁদে বলে, ‘আজ আমি এত টাকা পেয়েছি, আমার মাকে দিলে মা গুণে শেষ করতে পারতোনা। এই টাকা এখন আমার কি কাজে লাগবে? টাকা দেখলে এখন আমার কান্না পায়। টাকার অভাবে আমার মা বিনা চিকিৎসায় মারা গেল। টাকা তো পেলাম, কিন্তু আমার মা রইলোনা।’
প্রায় ২০দিনের ছুটি শেষ করার পর সনি আক্তার প্রথম কর্মস্থল হয় সিলেট শহরে। সেখানে সে সিপাহী পদে যোগদান করে। সেখানেও একমাস অতিবাহিত হওয়ার পর চাকুরির প্রথম বেতন পায়। এই টাকা পেয়েও সে কান্না শুরু করে। এখন তার টাকার অভাব নেই, অভাব শুধু মায়ের ভালোবাসার। তার কত স্বপ্ন ছিল মা’র চিকিৎসা করাবে, বাড়িতে একটা ঘর তুলে মাকে যত্ন করে রাখবে। মা জীবনে অনেক কষ্ট করেছেন। বাকি জীবনটা যেন সুখে কাটাতে পারে, তার জন্য যা যা করতে হয় সব করবে। কিন্তু কিছুই করা হলোনা।
হয়তো একসময় তার অপূর্ণ ইচ্ছেগুলো পূর্ণ হবে কিন্তু মা চলে যাওয়ার শূন্যস্থান আর কোনো দিন পূর্ণ হবেনা। যতদিন সনির বাবা বেঁচে থাকবেন ততদিন তাঁর ইচ্ছে পূরণ করবে সনি। কিন্তু সে ঠিক করেছে তার মায়ের বয়সী দরিদ্র, অসহায় নারীদের যতটুকু পারে সাধ্যমতো সাহায্য করবে। তার চোখের সামনে আর কোনো মাকে বিনা চিকিৎসায় মরতে দেবেনা।