সবজির বাজারমূল্য ভালো না থাকায় অন্য পেশায় ঝুঁকতে হচ্ছে

শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল

‘নিজেদের জমি জমা বলতে মোট দেড় বিঘা জমি। এর মধ্যে ৫ কাঠার মতো একটি পুকুর ও বাকিটা সবজির ক্ষেত ও বসতভিটা। এ বসতভিটায় বারোমাস বিভিন্ন ধরনের সবজি, মসলা, ডাল ও সরিষা চাষ হয়। মৌসুমের কোন ফসল চাষ করতে বাকি থাকে না এই ভিটায়। মূলত এটি একটি কৃষিবাড়ি, কৃষির সব রকমের কাজ হয় এখানে। বাড়িতে ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি হাঁস, মুরগি, গরু ও ছাগল পালন হয়। বিভিন্ন ধরনের ফলজ গাছও রয়েছে। পুকুরে রয়েছে নানান বৈচিত্র্যের মাছ। পরিবারের আয় রোজগারের বেশিটা হয় ভিটায় বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষাবাদের মাধ্যমে। পরিবারে স্বামী স্ত্রী ও ছেলে মেয়েসহ মোট ৪ জন সদস্য। সবকিছু মিলিয়ে ভালোয় চলছিলো আমাদের পরিবার। বসততভিটায় যে ফসল চাষাবাদ হয় তা যেমন বাড়ি থেকে এসে পাইকারী-খুচরা ব্যবসায়ীরা নিয়ে যেতো। আবার গ্রামের অনেক পরিবার তারে প্রয়োজনে নিয়ে যেতো মাঝে মধ্যে আমি ও আমার পরিবারের সদস্যরা বাড়ি বাড়ি বিক্রি করতাম।’ উপরোক্ত কথাগুলো বললেন শ্যামনগর উপজেলার কাশিমাড়ি ইউনিয়নের জয়নগর গ্রামের কৃষাণী অর্চনা রানী মন্ডল। তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু বর্তমান সময়ে সবজি ফসলের বাজারমূল্য কমে যাওয়াতে নানান সমস্যায় পড়তে হয়েছে। কোন ব্যবসায়ী সবজি কিনতে আসে না। কারণ সবজির বাজার মুল্য এতো কম যে তুলে বিক্রি করতে পারছিনা। এতে সবজি ক্ষেতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, যা ছিলো মানুষের খাদ্য তাই এখন গবাদির পশুর খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করতে হচ্ছে। সবজি চাষ বন্ধ করে বাইরের অন্য কাজের দিকে ঝুঁকতে হচ্ছে।’

কৃষাণী অর্চনা রানী বলেন, ‘আমার স্বামী প্রভাস মন্ডল একজন দিনমজুরি। সে বেশির ভাগ সময় নিজ বাড়ি ও এলাকাতে কাজ করেন। খুব বেশি সমস্যা না হলে এলাকার বাইরে কাজে যান না। যখন এলাকাতে কাজের সমস্যা এবং সবজি চাষের সমস্যা হয় তখনই বাধ্য হয়ে এলাকার বাইরে কাজে কখনো ইটের ভাটায় বা কখনো ধান কাটার কাজে যান। এখান থেকে প্রায় ৮ বছর আগে অতিরিক্ত তাপে ক্ষেতে লবণ উঠায় এবং ভালো সেচের ব্যবস্থা না থাকায় সবজি চাষ করতে না পেরে ভাটায় এবং ধান কাটতে বাইরে গিয়েছিলেন। ঠিক তেমনই অবস্থা হয়েছে এবার। করোনার মধ্যে দিয়ে স্বামী স্ত্রী মিলে ভিটার সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছি সবজি চাষের জন্য। ’


তিনি আরও বলেন, ‘শীতের সময় ক্ষেতে ওলকপি, বীটকপি, পালনশাক, গাজর, টমেটো, বেগুন, টক পালন, আলু, শিম, মূলা, পাতাকপি, ফুলকপি, ঝাল, পেঁয়াজ, রসুন, মৌরি লাগাই। এগুলোর ফলনও ভালো হয়েছে। প্রথমদিকে কিছু বিক্রি করতে পেরেছিলাম। পরে কিছু বিক্রি করতে পারিনি। কারণ বাজারে তরকারীর মূল্য খুব কম। ক্ষেতের মধ্যে এখন বেগুন, পাতাকপি, টমেটো, গাজর, বীটকপি, ওলকপি আছে কয়েক মণ। এগুলো এমনিই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অনেকে ক্ষেত থেকে বিনামূল্যে উঠিয়ে নিয়ে গেছে এবং গবাদী পশুর খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করছে। এরকম অবস্থা দেখে আমার স্বামী বাধ্য হয়ে আবার এলাকার বাইরে কাজের সন্ধ্যানে গেছে। সে এখন এলাকার বাইরে মাগুরায় রাজমিস্ত্রিীর যোগারে হিসাবে কাজ করছে।’

অর্চনা রানী জানান, শুধু তিনি নন এলাকায় কয়েক পরিবার রয়েছে যারা সবজি চাষের উপর নির্ভরশীল ছিলো। এখন তারা বাধ্য হয়ে বাইরে কাজে যুক্ত হচ্ছে। তাদের গ্রাম থেকে নাছিরউদ্দীন, সৌরেন্দ্র নাথ মন্ডল এরা সবাই এবছর ভাটার কাজে যুক্ত হয়েছে। সবজির বাজার মূল্য ভালো না থাকায় অন্য পেশায় ঝুকতে হচ্ছে। কারণ সবজির ভালো মূল্য পেলে তা দিয়ে সংসার চালানো যেতো কিন্তু যা মুল্য পাচ্ছেন তাতে কোনমতে সংসার চালানো সম্ভব হচ্ছে না।


মূলত কৃষি কাজের সাথে কৃষকের সম্পৃক্ততা। কৃষিকে সামনে নিয়ে যাওয়ার জন্য তারা দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। কৃষক তার শ্রমের ন্যায্য মূল্য পাবে তবেই তো তিনি তার কাজটা আরো ভালোভাবে ও সম্মানের সাথে করতে আগ্রহী ও উৎসাহিত হবেন। কিন্তু যখন তাঁর ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হবেন তখন এই পেশায় তিনি সুখী হবেন না। তখন বাধ্য হয়ে অন্য পেশার দিকে ঝুঁকবেন। তাই কৃষিপণ্যের সঠিক বাজার নির্ধারণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। তবেই না অর্চনা রানীর স্বামীর মতো কৃষকরা অন্য পেশার দিকে ঝুঁকে যাবেন না।

happy wheels 2

Comments