স্থানীয় বীজ সংরক্ষণ: নিরাপদ থাকবে উপকূল
সাতক্ষীরার শ্যামনগর থেকে গাজী আল ইমরান
আগেকার দিনে কৃষকের বাড়িতে বাড়িতে সংরক্ষিত থাকতো স্থানীয় জাতের বিভিন্ন ধরনের বীজ। কৃষক তার বাড়ি থেকে উৎপাদিত সবজি পরের বছর বপনের জন্য বিভিন্ন মাটির পাত্রে বীজ সংরক্ষণের পাশাপাশি অন্যদের কাছে বিনিময় করে থাকতো। কিন্তু বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দূর্যোগসহ নানা কারণে তা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।
স্থানীয় জাতের ধানসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষের মাধ্যমে সবুজের সমারোহ থাকতো পুরো উপকূলজুড়ে। স্থানীয় জাতের ১শ’র বেশি ধান থাকতো কৃষকের মাঠজুড়েই। কালের বিবর্তনে এসব সব কিছুই একেবারেই হারাতে বসেছে কৃষক। হারিয়ে যাচ্ছে উপকূলের ঐতিহ্য। কৃষকের মাঠ থেকে একেবারেই বিলুপ্তির পথে বসেছে একাধিক ধান ও সবজি। তবে বর্তমানে এলাকার কিছু কিছু কৃষক কৃষির অতীতকে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
ধুমঘাটের কৃষাণী অল্পনা রানী মিস্ত্রি’র কৃষি শতবাড়ি পরিদর্শনে দেখা যায়, বিভিন্ন ধরনের সবজির বীজ শুকাতে দিয়েছেন উঠান জুরড়। কৃষিতে বৈচিত্র্য আর ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে কোনোভাবেই থেমে নেই এই প্রান্তিক নারী। উঠানে দেখা যায় নিজের পরনের ওড়না, চালন, ঝুড়ি, কুলাসহ বিভিন্ন পাত্রে রেখেছেন বিভিন্ন ধরনের সবজি বীজ। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য বেগুন, পুইশাক, ঝাল,পাল, ডাটা শাক,লাল শাক, ২২ প্রজাতির সিমসহ নানাবিধ সবজির বীজ।
শুধু এই কৃষাণীর মধ্যে আজ তা সীমাবদ্ধ নেই। এই ব্যাপ্তি আজ উপকূলের সচেতন কৃষকর মাঝে আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ছে। কৃষক এখন স্থানীয় বীজ এবং হাইব্রিড বীজের পার্থক্য করতে শিখেছেন।
বাজার ঘুরলে দেখা যায় হাইব্রিড বীজের জয়জয়কার অবস্থা। আর এই বীজে উপকূলে কোনো প্রকার নিরাপদ থাকতে পারছে না। হাইব্রিড বীজ রোপণে কৃষককে এখন কোম্পানির প্রিসক্রিপশন অনুযায়ী চলতে হয়। বীজের সাথে ধরিয়ে দেওয়া হয় রাসায়নিক কীটনাশকের চোতা। যা ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষের স্বাস্থ্য, মাটির স্বাস্থ্য, বিভিন্ন জীব বৈচিত্র্যের স্বাস্থ্য এবং বায়ুর স্বাস্থ্য।
শ্যামনগর উপজেলা সদরের চ্যানেল আই কৃষি পদক কৃষক সিরাজুল ইসলাম পরিচালিত কৃষক সেবা সংগঠন নামের একটি সংগঠনে দেখা যায়, ১২৬ ধরনের স্থানীয় জাতের ধান। তিনি প্রতিবছর এই ধানগুলো চাষের মাধ্যমে টিকিয়ে রেখেছেন স্থানীয় ধান বৈচিত্র্য। এই কৃষকের ধান সংরক্ষণের কথা শুনে কিছুটা হলেও হতবাক হওয়ার মতো। এতো প্রজাতির ধান বর্তমান প্রজন্মের কাছে হয়তোবা শুনে বিশ্বাস নাও করতে পারে।
কৃষক সিরাজুল ইসলামের সাথে এই ধান নিয়ে কথা হলে তিনি বলেন, ‘স্থানীয় ধান রোপণে কীটনাশক এবং সারের পরিমাণ একেবারেই কম লাগে। এছাড়া আমরা জৈব পদ্ধতিতে এই ধান চাষের চেষ্টা করে থাকি। হাইব্রিড ধানে অধিক পরিমাণ সার এবং কীটনাশকের পরিমাণ প্রয়োজন হয়। হাইব্রিড রোপণে ফলন বেশি হয়, তবে স্থানীয় ধানে সার কীটনাশক কম লাগায় খরচের পরিমাণ কম হয়।’ তিনি বলেন, ‘মানুষ বিভিন্ন ফসলে অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে শারীরিক এবং পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।আমরা কিছু কৃষক মিলে চেষ্টা করছি স্থানীয় জাতের ধানসহ বিভিন্ন সবজির বীজ সংরক্ষণ করে উপকূলকে নিরাপদ রাখতে।’
বীজের ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে ১২শ’ প্রকারের বীজ সংরক্ষণ করেছেন ধুমঘাটের গণেষ মন্ডল। বিভিন্ন জাতের সবজি বীজসহ বৃক্ষের বীজ সংরক্ষণ করে রেখেছেন তিনি। পেশায় তিনি একজন ধর্মীয় গুরু। তিনি সময় পেলেই সংরক্ষণ করেন বিভিন্ন ধরনের বীজ। প্রাচীন ঐতিহ্য ধরে রাখতে চালু রেখেছেন বিনিময় প্রথা। মানুষের প্রয়োজনে তিনি বীজ দিয়ে থাকেন এবং বীজের বিনিময়ে মানুষের কাছে থাকা অন্য বীজ নিয়ে থাকেন।
বিনিময় প্রথা লক্ষ্য করা গেছে রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজধানী খ্যাত ধুমঘাট গ্রামের বঙ্গবন্ধু কৃষি পদক প্রাপ্ত কৃষাণী অল্পনা রানী মিস্ত্রির বাড়িতে। তিনি তার বাড়িতে থাকা আড়াই শতাধিক জাতের বিভিন্ন ধরনের সবজিসহ ঔষধি গাছের বীজ বিনিময় করেন গ্রামের অন্য কৃষকের মাঝে। বীজ দিয়ে তিনি আবার প্রয়োজনে স্থানীয় জাতের অন্য বীজ নিয়ে থাকেন।
কৃষাণী অল্পনা রানী মিস্ত্রি বলেন, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং হাইব্রিডের অধিক প্রচলনে স্থানীয় বীজ হারাতে বসেছি আমরা। অধিক মুনাফার লোভে আমরা হাইব্রিড বীজ ব্যবহার করে নিজেদের হুমকির মুখে ফেলে রেখেছি। হাইব্রিড বীজ চাষের ফলে অধিক পরিমাণ কীটনাশক ব্যবহার করা হয় যা মানুষের শরীরে ক্ষতিকর প্রভাবের পাশাপাশি মাটি তার উর্বরতা হারিয়েছে।’
কৃষক ভাবতে শুরু করেছেন আগামীর কথা। এভাবে কীটনাশকের মাধ্যমে হাইব্রিড চাষ করতে থাকলে একদিন মাটি তার গুনাগুণ এরকবাররই হারিরয় ফেলবে। পরিবেশের বাস্তু সংস্থান ভেঙে পড়বে। পরিবেশ মানুষের সাথে আচরণ বদলে ফেলতে পারে যা বর্তমানে ঘটছে। আর এটি ঘটতে পারে এই কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে। সুতরাং স্থানীয় বীজের চাষাবাদ অতি উত্তম এমনটাই ভাবছেন প্রবীণ কৃষকরা।
কৃষক ভাবছেন মাটির অদূর ভবিষ্যৎ নিয়ে। অধিক মুনাফার আশায় বিদেশী বীজ আর অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে মাটি কতটা অসহায় হয়ে পড়েছে তা উপলব্ধি করছেন একমাত্র কৃষক। কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, হাইব্রিড বীজ চাষ করতে গিয়ে অধিক থেকে অধিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার করা লাগে যার ফলে মাটি তার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছ। আর প্রতিবছর এর ব্যবহার বেড়ে যাচ্ছে। এবছর যে পরিমাণ কীটনাশক লাগছে পরের বছর তার চেয়ে অধিক পরিমাণ কীটনাশক ব্যবহার করা লাগছে। সুতরাং কৃষক ভাবছেন হাইব্রিডের ব্যবহার কমিয়ে স্থানীয় বীজের ব্যবহার বাড়াত।