করোনা দুর্যোগ মোকাবেলায় কৃষকের বন্ধু হাওর বীজঘর
নেত্রকোনা থেকে মো. অহিদুর রহমান
করোনাকালিন সময়ে বাজার থেকে বীজ সংগ্রহ করতে না পেরে অনেক কৃষকের নির্ভরতার আশ্রয় ছিলো হাওর বীজঘর। শুধুমাত্র একটি ফসল বোরো মৌসুমে ধানের চাষ করা যায়। হাওরাঞ্চলে বছরের অধিকাংশ সময় পানি থাকায় অন্য কোন ফসলের চাষ করতে পারেনা হাওরবাসী। বীজ সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে সমস্যা এবং মানসম্মত বীজ না পাওয়ায় হাওরের কৃষকরা শস্যফসল চাষে তেমন আগ্রহ দেখায় না। রবিশস্য ফসলের মধ্যে সামান্য পরিমাণে সরিষা, মাসকলাই, বাদাম ও মরিচ এবং শীতকালীন সবজি চাষ হয়। কিন্তু এসব ফসলের অধিকাংশই হাইব্রিড জাতের হওয়ায় এসব ফসলের বীজ উৎপাদন, সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ করতে না পারায় হাওরাঞ্চলে সবজি ও অন্যান্য শস্য ফসলের বৈচিত্র্য তেমন চোখে পড়েনা।
বারসিক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, মতবিনিময় সভা গ্রামসভার মাধ্যমে গত তিনবছরে হাওরের কৃষকদেরকে ধানের বিকল্প ফসল চাষের জন্য উৎসাহ প্রদান করতে থাকেন। গোবিন্দশ্রী ও মদন ইউনিয়নের কৃষকদেরকে ধানের বিকল্প ফসলের জাত নির্বাচনের জন্য কৃষক নেতৃত্বে রবি মৌসুমে শস্য ফসলের প্রায়োগিক গবেষণা স্থাপনে সহযোগিতা প্রদান করে। প্রায়োগিক গবেষণার জন্য ২৩টি জাতের শস্য ফসলের বীজ দেখে তাদের মধ্যে গবেষণা কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। কৃষকরা তাদের জমিতে ও বসতভিটার সামান্য জমিতে বৈচিত্র্যময় ফসল চাষের আগ্রহ প্রকাশ করে সেসব ফসলের বীজের জন্য বারসিক’র নিকট দাবি জানান। কৃষকদের চাহিদার ভিত্তিতে এবং বীজ সংরক্ষণ করে পরবর্তীতে বীজঘরে বীজ ফেরত দেওয়ার শর্তে মদন ও গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নের কৃষক-কৃষাণীদের জন্য ২৮ জাতের শস্যফসলের বীজ সহযোগিতা করা হয়।
এলাকার কৃষকরা নিজেরা বীজ উৎপাদন করে বীজঘরে বীজ সংরক্ষণ করবে ও পরস্পারিক বীজ বিনিময়ের মাধ্যমে নিজেদের বীজের চাহিদা মেটাবে, বীজের জন্য বাজার নির্ভরশীলতা কমাবে, কৃষকদের মধ্যে পারস্পারিক ও আন্তঃনির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাবে এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে উচিতপুর ও গোবিন্দ্রশ্রী গ্রামের খালাসিপাড়া ও গুচ্ছগ্রামে বীজঘর তৈরি করে। প্রায়োগিক কৃষি গবেষণায় বাছাইকরা বীজ ও কৃষক প্রতি মৌসুমে ক তাদের উৎপাদিত ধান, সবজি, শস্য, মসলা ও অন্যান্য ফসলের বীজ উৎপাদন ও সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা শুরু করেন। শুধু নিজ এলাকার নয় অন্য এলাকা বা গ্রাম থেকে বীজ সংগ্রহ করে বৈয়ম, ড্রামে, বোতলে সংরক্ষণ করেন। বীজ ঘরের বীজ সংরক্ষণ, বিনিময় ও বিতরণের জন্য বীজ রেজিষ্টার, বীজ বিতরণ/বিনিময় রেজিষ্টার সংরক্ষণ করেন। বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, বিতরণ ও অন্যান্য রেজিষ্টার নিয়মিত ও হালনাগাত করে থাকেন। বীজ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য ও পরামর্শ দিয়ে থাকেন। বীজ সম্পর্কে ধারণাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন সময়ে আলোচনা, মতবিনিময় সভা অভিজ্ঞতা বিনিময় সফর, প্রশিক্ষণ এবং বীজ মেলা বীজ বিনিময় অনুষ্ঠান করে থাকেন।
মহামারি করোনাকালে যখন সবকিছুই বন্ধ থাকে তখন হাওরাঞ্চলের এই তিনটি বীজঘর থেকে ২৩৫টি কৃষি পরিবারকে বীজ সহায়তা প্রদান করে বীজঘর ব্যবস্থাপনা কমিটি। আশেপাশের ৫টি গ্রামের কৃষক কৃষাণীরা বীজঘরের উপর আপদকালীন সময়ে নির্ভরশীল হন।
দেখা যায়, উচিতপুর গ্রামের আরো ২০টি পরিবার নিজ নিজ ঘরে শস্য, ফসলের বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করছেন। নিজেদের পরীক্ষিত বীজের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন হয়েছে।
বর্তমানে বীজঘরগুলোতে মৌসুমভিত্তিক শাকসবজি যেমন-করলা, আলু, মরিচ, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, খিরা, শসা, ফুলকপি, বাধাকপি, ডাটা, পালংশাক, পুইশাক, লালশাক, ঢ়েড়স, শালগম, ইত্যাদি, মসলা ফসল যেমন- ধনিয়া, গুয়ামুড়ি, কালজিরা, পেয়াজ, রসুন ইত্যাদি এবং শস্য ফসল যেমন-সরিষা, বাদাম ইত্যাদি বৈচিত্র্যময় ফসল চাষ করছেন এবং অধিকাংশ ফসলের বীজ নিজেরা সংরক্ষণ করছেন।
হাওর বীজঘরের ফলে হাওরের কৃষকরা কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ মোকাবেলা ও অভিযোজনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। বীজঘরে বীজ সংরক্ষণ ও পরস্পরের মধ্যে বীজ বিনিময়ের ফলে হাওরের কৃষকদের মধ্যে পারস্পারিক সর্ম্পক উন্নয়ন ও আন্তঃনির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। শস্য ফসলের বৈচিত্র্যতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষকরা একদিন হাওরের একমাত্র ফসল বোরো ধানের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে ধানের বিকল্প ফসল চাষ বৃদ্ধির মাধ্যমে হাওরের কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ মোকাবেলা ও অভিযোজনে সক্ষম হবেন বলে আমরা মনে করি।