কুমুদিনী হাজংদের কৃষি মানস ও হাওর কৃষকদের কৃষি সংকট
নেত্রকোনা থেকে রনি খান
হাজংমাতা রাশিমনি স্মৃতিসৌধ ছাড়িয়ে বাংলাদেশ সীমান্তের একেবারে খুব কাছেই বহেরাতলী গ্রাম। এই গ্রামেরই একটি টিলার উপর পরিবারের সাথে বাস করেন কুমুদিনী হাজং। কুমুদিনী হাজং মানে একটি জীবন্ত ইতিহাস। ‘কুমুদিনী হাজং’ এই নাম মনে হওয়ার সাথে সাথে মনে হবে কৃষকদের এক হার না মানা লড়াইয়ের প্রতিচ্ছবি। এক রক্তাক্ষ সংঘর্ষের ইতিহাস। ‘খাজনা’র হার নির্ধারণকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া সেই আন্দোলনকে আমরা জানি ইতিহাস বিখ্যাত টংক আন্দোলন নামে। টংক আন্দোলনের এক জীবন্ত স্বাক্ষী কুমুদিনী হাজং। আমরা যখন কুমুদিনী হাজং এর বাড়িতে পৌছাই তখন দুপুর। কুমুদিনী হাজং তার বাড়ির পিছনের দিকটায় বসা। শতোর্ধ্ব কুমুদিনী হাজং এর শরীরে বাসা বেঁধেছে নানান জরা। বয়সের ভারে ন্যুব্জ তিনি। মনে করতে পারেন না এখন আর তেমন কিছুই। বলতেও পারেন না। যা বলেন তাও অস্পষ্ট। চোখেও দেখেন কম। তাকে কেন্দ্র করেই যে রক্তাক্ত সংঘর্ষটা ঘটে গিয়েছিলো, শহীদ হয়েছিলেন হাজং মাতা রাশিমনি হাজং-সুরেন্দ্র হাজং, মাথায় হুলিয়া নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন পাহাড়ে পাহাড়ে তার কিছুই এখন তার মনে নেই। খুব একটা মনে নেই স্বাধীনতা সংগ্রামের কথাও। সেবারও তাঁরা দেশান্তরি হয়েছিলেন। মনে থাকলেও বলতে পারেন নি কিছুই। যাঁর জীবনের উপর দিয়ে এতোকিছু ঘটে গেছে, এক সংগ্রাম মুখর রাজনৈতিক জীবন যার তিনিও এখন আর তেমন কিছুই বলতে পারছেন না সে বিষয়ে। আমরা ব্যর্থ যখন মনোরথ হয়ে ফিরে আসবো তখন আমাদের সঙ্গী শংকর দা (শংকর ¤্রং) তাঁর (কুমুদিনী হাজং) এর নাতনি হেপি হাজং এর কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিলেন কিছু কার্পাস তুলার বীজ। বয়সের ভারে ন্যুব্জ, ডিমেনসিয়ায় আক্রান্ত কুমুদিনী হাজং সব ভুলে গেলেও ভুলেননি বীজ বপনের প্রক্রিয়া। তিনি আমাদেরকে শিখিয়ে দিচ্ছিলেন কি করে কার্পাস তুলার বীজ বপন করতে হয়। বীজের ব্যাগটা আমাদের হাত থেকে নিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিলেন কয়টা করে বীজ কীভাবে বপন করতে হবে। এক ঐতিহাসিক কৃষক সংগ্রামের নেত্রী কুমুদিনী হাজং এর কৃষি চেতনা এখানেই আমাদেরকে সজাগ করে তুলে। আমাদেরকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আমাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়- আমাদের শেকড়, আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের শক্তি। একই সাথে আমাদেরকে ভাবাতে বাধ্য করে কৃষকের অধিকার শুধুমাত্র- খাজনা আর উৎপাদনেই সীমাবদ্ধ নয়। বীজ, বীজের দখল, আমাদের জনমানস, আমাদের সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস এ সবকিছু মিলিয়েই আমাদের কৃষি।
কৃষি মানে কি শুধুই উৎপাদন? নিষ্ফলা জমির বুক ছিঁড়ে ফসল উৎপাদনের নামই কি কৃষি? বাঙ্কারের মতো আবদ্ধ ঘরে ডিম আর মাংস কিংবা একুরিয়ামের মতো ‘ফিসারি’তে মৎস উৎপাদনের মতো মেশিনের নামই কি কৃষি? উৎপাদনের নামে কৃষকের মগজ ও জমিনকে লাভ ও লোভের কর্পোরেট ইঁদুর দৌড়ে লাগানোর নামই কি কৃষি? অন্তত কৃষির ইতিহাসকে বিবেচনায় নিলে এর উত্তর হবে ‘না’। কৃষি মানে একটি সামগ্রিক জীবন। অন্তত এ ভূখন্ডের ইতিহাস তাই বলে। এ ভূখন্ডের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, প্রাত্যহিক জীবনাচরণ গড়ে উঠেছে কেবলমাত্র কৃষিকে কেন্দ্র করেই। ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলের মতো ক্ষুদ্র একটি ভূখন্ডের ১৭ কোটি জনতার দেশে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা সম্ভব হয়েছে এই কৃষকের সাহস, সক্ষমতা আর অভিজ্ঞতার বলেই। বাংলাদেশের খাদ্যভান্ডার খ্যাত হাওরাঞ্চলে বছর বছর উজানের ঢল আর শিলা বৃষ্টির মতো ভয়ংকর বিপদকে মাথায় রেখেও প্রতিবছরই বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ মানুষের মুখে খাদ্য তুলে দেয়ার দায়িত্ব নেয় এই দুরন্ত সাহসী কৃষকেরা। এই কৃষকেরাই টংক প্রথা থেকে শুরু করে হালের বান-বন্যা-বজ্রপাত সব কিছুকে মোকাবেলা করেই গড়ে তুলেছে এক বৈচিত্র্যময় জীবনাখ্যান। শুধুমাত্র কর্পোরেট বাণিজ্যের লাভ আর ত্রাণের লোভ দিয়ে এই কৃষকদের পরিমাপ করা কখনোই সম্ভব নয়। জান-মান-ধানের সংকট তাদের কাছে এক সরল রেখার সংগ্রাম। সঙ্গত কারণেই ফসল রক্ষার সংগ্রাম তাদের কাছে জান রক্ষার সংগ্রামও হয়ে উঠতে পারে। টংক আন্দোলন এমনই এক সংগ্রামের নাম। যে আন্দোলন শুরু হয় ‘টংক প্রথা’র নামে প্রচলিত খাজনার পরিমাণ ধার্য করার দাবি দিয়ে কিন্তু শেষ হয় জমিদারি প্রথা বিলুপ্তি দাবি নিয়ে।
উজানের ঢল, শিলাবৃষ্টি, নেকব্লাস্ট, কোল্ড ইনজুরি, হট ইনজুরি, জলমহাল ইজারাদার ইত্যাদি নানা ধরণের বিপদ-আপদের সাথে যুদ্ধ করা হাওরবাসীর জনমনস্তত্ত্বই আমাদেরকে নতুন করে পাঠ করতে হবে। বাংলাদেশের সীমান্তেরই আরেক কৃষক মোতালেব ভাই যেমন বলেন ‘বিষ খাইলে মরে একজন/ আর বীজ খাইলে মরে হাতওগোষ্ঠী (গোষ্ঠীসহ সবাই)।’ বীজ সুরক্ষা, মাটি সুরক্ষা, ফসল সুরক্ষা এবং জীবন সুরক্ষা এই সবই তাদের কাছে একই সূত্রে গাঁথা। কৃষিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এ অঞ্চলের সামাজিক-ভৌগলিক ব্যবস্থাপনা থেকে আমরা বুঝতে পারি- ২০২২ সালের নজিরবিহীন বন্যা হোক কিংবা বঙ্গবাজারের ভয়াবহ আগুন, পাহাড়ি ঢল হোক বা হাওরে মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়া ধানের ছিটা রোগ বা শিলাবৃষ্টি, ভোগবাদের কাছে সমর্পিত উন্নয়ন দর্শন দিয়ে এ সংকট সমাধান আদৌ সম্ভব নয়। সম্ভব নয় বিষ, সার, প্লাস্টিকসহ আরো নানা ধরণের কর্পোরেট আবর্জনার ভাগাড় করে ফেলা হাওর-নদী রক্ষাও।
সেক্ষেত্রে আমাদের ফিরে যেতে হবে কুমুদিনী হাজংদের কাছেই। তাঁদের কৃষি মনস্তত্ত্বই আমাদের সম্পদ। আমাদের মনে রাখতে হবে আজকে যখন জাতিসংঘ ‘সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল-এসডিজি’ নির্ধারণ করে বলছে- মাটির গুণ অক্ষুন্ন রাখতে হবে, পরিবেশের ক্ষতি করা যাবে না, প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার হতে হবে সহনশীল, প্রতিবেশ নির্ভর অভিযোজন করতে হবে ইত্যাদি, তারও বহু আগে থেকেই কুমুদিনী হাজংদের মতো ‘প্রান্তিক’(!) মানুষেরাই আমাদের হাওর-পাহাড়-নদীকে কেন্দ্র করে তাদের জীবন-জীবিকা-সংস্কৃতি গড়ে তুলেছেন। হাওরকে অক্ষত রেখেই হাওর নির্ভর জীবন যাপন করেছেন, পাহাড়কে অক্ষত রেখেই পাহাড় নির্ভর সংসার গড়ে তুলেছেন, নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে তুলেছেন জীবনের অমৃত আখ্যান। আরোপিত উন্নয়ন আর কর্পোরেট দাসত্ব আমাদের সেই অমৃত কে গরল করে তুলেছে। সেই গরলকে পূণরায় অমৃতের ছোঁয়ায় শুদ্ধ করার দায় আমাদের। আমরা যদি এখনও কৃষকের উন্নয়নের জন্য কৃষক নেতৃত্বের কথা না ভাবি, হাওর উন্নয়নের জন্য হাওরবাসীর নেতৃত্বের কথা না ভাবি, আমাদেরকে জবাবদিহি করতে হবে। জবাবদিহি করতে হবে কুমুদিনী হাজংদের কাছেও, জবাবদিহি করতে হবে আমাদের উত্তর প্রজন্মের কাছেও। কুমুদিনী হাজংসহ বাংলাদেশের অসংখ্য খাদ্যযোদ্ধা, ‘দেশমাতারই মুক্তিকামী’ “কৃষক”দের কাছে এই দায় স্বীকার করেই আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তবেই হবে আমাদের কাঙ্খিত ‘টেকসই’ উন্নয়ন।