খাদ্য নিরাপত্তা নয় বরং খাদ্য সার্বভৌমত্ব অর্জন এখন সময়ের দাবি
সিংগাইর, মানিকগঞ্জ থেকে শিমুল বিশ্বাস
কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং খাদ্যস্বার্বভৌমত্ব বর্তমান প্রেক্ষাপটে খুবই গুরুত্বপুর্ণ আলোচিত বিষয়। পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখতে এবং মানুষসহ সকল প্রাণের বেঁচে থাকার জন্য নিরাপদ খাদ্যের যোগান, সকল ধরনের ন্যায্যতা ও অধিকার নিশ্চিত করতে হলে উপরোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় বাইরে রাখার কোন সুযোগ নাই। কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যা চর্চা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং খাদ্যস্বার্বভৌমত্ব বিষয়ে যতবেশী প্রচারণা, জনসচেতনতা ও জন সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পাবে ততোটাই হ্রাস পাবে অন্যায্যতা। তাই বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক তার উন্নয়ন উদ্যোগে কৃষিপ্রবিবেশ বিদ্যা, জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্য স্বার্বভৌমত্বের বিষয়টি অধিকতর গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে আসছে।
সম্প্রতি কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং খাদ্যস্বার্বভৌমত্ব বিষয়ক ৩দিন ব্যাপী স্টাফ দক্ষতা উন্নয়ন কর্মশালার আয়োজন করে বেসরকার গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক। সিংগাইর উপজেলা রিসোর্স সেন্টারের প্রশিক্ষণ কক্ষে অনুষ্ঠিত এ কর্মশালায় সহায়কের ভুমিকা পালন করেন বারসিক’র পরিচালাক সৈয়দ আলী বিশ^াস ও কৃষিবিদ তৌহিদুল আলম এবং সিলভানুস লামিন। কর্মশালায় বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় বিশেষ মাত্রা যোগ করেছিলেন বারসিক’র নির্বাহী পরিচালক সুকান্ত সেন, পরিচালক রোমাইসা সামাদ এবং দাতা সংস্থা দি- সোয়ালোজ ইন্ডিয়া- বাংলাদেশ প্রতিনধি শিউলী হক।
প্রশিক্ষণে বারসিক’র নির্বাহী পরিচালক সুকান্ত সেন স্টাফদের বিশ্লেষণ দক্ষতা বৃদ্ধির উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন, ‘বর্তমান সংকটে কারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত সেটা জানাবোঝা জরুরি। যারা বেশি প্রান্তিক তাদের তালিকা প্রনয়ণ করতে হবে। যাতে দ্রুত সহায়তা প্রদান করা যায়।’ তিনি আরো বলেন, ‘সব ধরনের বিশ্লেষণ ও চিন্তার ক্ষেত্রে জেন্ডার, প্রবীণ, শিশু, বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তি ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে গুরুত্ব দিতে হবে।’ এ কর্মশালায় বারসিক’র মাঠ পর্যায়ের কর্মী ছাড়াও অংশগ্রহণ করেন কৃষক সংগঠন ও যুব সংগঠনের প্রতিনিধিগণ। কর্মশালায় কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যা, জলবায়ু পরিবর্তন/ ন্যায্যতা এবং খাদ্যস্বার্বভৌমত্ব এ তিনটি বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচানা হয়। কর্মশালায় দলীয় অনুশীলন এবং বিষয়ভিত্তিক আলোচনার মধ্যদিয়ে বেশ কিছু শিখন ও সুপারিশ চিহ্নিত করা হয়, যা কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যা চর্চা, জলবায়ু ন্যায্যতা এবং খাদ্যস্বার্বভৌমত্ব অর্জনের পথকে তরান্বিত করতে সহায়তা করেবে বলে মনে করেছেন কর্মশালার অংশগ্রহণকারীগণ।
কর্মশালায় উঠে আসে যে, কৃষি প্রতিবেশবিদ্যা একটি সামগ্রিক বিষয়। শুধু জৈবকৃষি চর্চার ভেতর আবদ্ধ থাকলে কৃষি প্রতিবেশবিদ্যার সামগ্রিক বিষয় অনুধাবন করা কঠিন। কেননা কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যা পৃথিবীর সকল প্রাণির অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত। কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যা হলো পরিবেশের সাথে কৃষি ফসলের আন্তঃসম্পর্কের বিদ্যা, যা লাভজনক এবং জলবায়ু সহিষ্ণু ও সামাজিক ন্যায্যতার ভিত্তিতে পরিচালিত প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষি পদ্ধতি ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা। অন্যদিকে কৃষি প্রতিবেশবিদ্যা সকল ধরনের ন্যায্যতা ও অধিকার ও মর্যাদাকে সমর্থন করে। তাই খাদ্য স্বার্বভৌম্বত্ব নিশ্চিত করতে হলে কৃষি প্রতিবেশবিদ্যাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ কৃষি প্রতিবেশবিদ্যা বিকল্প কৃষি চর্চায় উৎসাহিত করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মঞ্চ নির্মাণে সহায়তা করে।
অন্যদিকে খাদ্য স্বার্বভৌমত্ব বুঝতে হলে বুঝতে হবে কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যাকে। কৃষি প্রতিবেশ বিদ্যা তিনটি মুল ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে। মূল ভিত্তি তিনটি হলো: ক) খাদ্য উৎপাদনের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক প্রেক্ষিত, খ) বাস্তুতন্ত্র ও খাদ্যজাল, গ) বিকল্প কৃষি চর্চার সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। কৃষি প্রতিবেশ বিদ্যা কৃষক, মাটির উর্বরতা, প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র, স্থানীক জ্ঞান, আন্তঃনির্ভরশীলতা এবং নবায়নযোগ্য শক্তিকে অধিক গুরুত্ব দেয়।” এ আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে, প্রাণবৈচিত্র্য কৃষিপ্রতিবেশ বিদ্যার অন্যতম উপাদান। যে এলাকায় যতবেশী বৈচিত্র্যতা থাকবে সেই এলাকা ততো বেশি সমৃদ্ধ হবে।
আবার কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় ও মানুষসহ সকল প্রাণির দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় নেতিকবাচাক প্রভাব পড়ার অন্যতম কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। যা মানুষের কর্মকান্ড দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে কৃষিপতিবেশবিদ্যা এবং খাদ্য সার্বভৌমত্বের গভীর যোগসূত্র রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন না হলে পৃথিবীতে বৈচিত্র্যতা থাকবে না। আবার জলবায়ুর দ্রুত ও অস্বাভাবিক পরিবর্তন পৃথিবীর প্রাণবৈচিত্র্যের অস্তিত্বের সংকট তৈরি করছে। এ সংকট কৃষি প্রতিবেশবিদ্যা চর্চার ক্ষেত্রে বড় ধরনের বাধা তৈরি করছে, বিঘিœত হচ্ছে ভোক্তা ও উৎপাদকের নিয়ন্ত্রণ ও অধিকার।
শিল্প বিপ্লব আধুনিক পৃথিবী গড়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে এটা যেমন সত্য, জলবাযু পরিবর্তন এবং বাণিজ্যিক কৃষির প্রসারে শিল্পবিপ্লবের ভূমিকা ততোটাই বাস্তব। শিল্প বিপ্লবের কারণে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো উন্নত দেশের কলোনীতে পরিণত হয়েছে। উন্নত দেশগুলোর উপনিবেশিক চিন্তা চেতনার কারণে কৃষিতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে অধিকাংশ অনুন্নত দেশগুলো। কৃষিতে বেড়েছে যান্ত্রিকিকরণ ও রাসয়নিকের মাত্রারিক্ত ব্যবহার। যদিও কৃষি উৎপাদন বেড়েছে অনেকগুণ। তবে নিরাপদ খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে বিশ^ব্যাপী। আবার যদি বলি কৃষি যান্ত্রিকীকরণে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চত হলেও অনুন্নত ও উন্নয়শীল দেশগুলোর খাদ্য স্বার্বভৌমত্বে আঘাত হেনেছে। বর্তমানে ভোক্তা ও উৎপাদকের খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্য গ্রহণের উপর নিয়ন্ত্রণ ও অধিকার খর্বিত হয়েছে। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে খাদ্য নিরাপত্তা নয় বরং খাদ্য সার্বভৌমত্ব অর্জনের উপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।