কৃষি প্রতিবেশবিদ্যা চর্চায় কৃষক দম্পতির সফলতা
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
একসময় উপকূলীয় এলাকায় প্রতিটি বাড়ি প্রতিটি গ্রাম ছিলো কৃষি সমৃদ্ধ। বাড়ি বা গ্রামের বাইরের দৃশ্য দেখলে বোঝা যেতো কত রকমের প্রাণবৈচিত্র্য রয়েছে। আর তার সাথে ছিলো যৌথ পরিবার যেখানে একেক পরিবারে সম্পর্কের মানুষগুলো ছিলো একই সুতোয় গাঁথা। বাড়ির বৃদ্ধ থেকে শুরু করে শিশু পর্যন্ত। বাড়িতে পালন হতো নানান ধরনের সাংস্কৃতি অনুষ্ঠান। আর সেটি শিশুর ভূমিষ্ট হওয়ার খবর থেকে শুরু করে নানান পর্যায়ে মধ্যে। পরিবারের সকল সদস্য একসাথে থাকায় যেন বাড়িতে সবসময় খুশি ও আনন্দের বন্যা বয়তো। কালের বিবর্তনে যেমন কৃষি সমৃদ্ধ বাড়ি নেই তেমনি গ্রামে যৌথ পরিবার খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন। তারপরও গ্রাম বাংলার কিছু পরিবার এখনো তাদের পূর্ব পুরুষদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং কৃষি প্রতিবেশ চর্চা নিজস্ব জ্ঞান দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে টিকিয়ে রেখেছেন। তেমনই সফল কৃষক দম্পতি শ্যামনগর উপজেলার নুরনগর ইউনিয়নের মোরালীকাটি গ্রামের পরিমল ও বিজলী রানী জোয়ারদার।
কৃষক দম্পতি পূর্বপুরুষদের যে কৃষিচর্চা ছিলো সেটি ধরে রেখেছেন। এটিকে পুঁজি করে সংসারের চাকাকে সচল রেখেছেন। সাথে পরিবারের সকল সদস্যকে কম বেশি করে এই কাজে যুক্ত করেন। পরিমল বিজলী দম্পতিরা এক যৌথ পেিবারের সদস্য। তাদের পরিবারের বাবা মা, ভাই ভাইয়ের বৌ, তিন ভায়ের সন্তান সব মিলে ১২ জন সদস্য। নিজেদের জমি জমা বলতে প্রায় ১৬ বিঘা জমি। আর তার মধ্যে ১২ বিঘা জমিতে মাছ চাষ করেন এবং বাকি জমি বসতভিটা। যেখানে বছরব্যাপি বিভিন্নœ ধরনের ফসল চাষাবাদ করেন। তাদের বসতভিটায় সবজির মধ্যে লাউ, মিষ্টিকুমড়া, বরবটি, বেগুন, ঢেড়স, পুইশাক, শসা, উচ্চে, ওল, উচ্চে, তরুল,শিম, কঢ়ুরমুখী, কচু, চালকুমড়া, ফুটি,করলা, বিভিন্ন জাতের আলু চুবড়ী আলু, গোল আলু, শাক আলু, লালশাক, পালনশাক, মূলা ওলকপি, পাতাকপি, বীটকপি, ফুলকপি, ব্রকলি, ডাটাশাকসহ প্রভৃতি। আবার বিভিন্ন জাতের কলার যেমন ডয়রা, বড়বাবলে, কাঁচকলা, ঠুঠে কলা, সবরী কলা রয়েছে। মসলা হিসাবে, ঝাল, আদা, হলুদ, ধনে, মৌরি, পেয়াজ, রসুন, ও তেজপাতা রয়েছে। তেল হিসাবে সরিষা চাষ। ডাল জাতীয় চৈতী মুগ। অচাষকৃত উদ্ভিদ হিসাবে আছে হেলাঞ্চ, কলমি, বউটুনি, পেপুল, গিমে শাক, বাতো শাক ইত্যাদি।
এছাড়াও বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের ফলজ গাছ আম, জাম, কাঁঠাল, নারকেল, কুল, পেঁপে, ডালিম, ছবেদা, গবেদা, আনারস, পেয়ারা, কাট বাদাম, বাতাবি লেবু, আমড়া, কদবেল, বেলসহ নানান ধরনের গাছ। কাঠ জাতীয় গাছ আছে মেহগনি, আকাশমনি, শিশু গাছ, খৈ, বাবলা ইত্যাদি। পুকুরে আছে নানান ধরনের মাছ। এছাড়াও বাড়ির নিচে বেড় পুকুর ও ঘেরে যেমন লবণ পানির বিভিন্ন মাছ সাথে ঘেরের রাস্তায় মাচা তৈরি করে বিভিন্ন ধরনের সবজি ফসল চাষ করেন। ধান ও মাছের পাশাপশি বাড়ির উপরে এবং চিংড়ি ঘেরের জমিতে বর্ষার সময় স্যালো পানি ও বৃষ্টির পানি ব্যবহার করে ধান চাষ করেন।
এগুলোর পাশাপশি কৃষক দম্পতির বাড়িতে গরু আছে ৫টি, ছাগল আছে ১৬টি, ভেড়া ৩২টি, মুরগি আছে ২৫টি, পাতি হাঁস ১০টি, রাজ হাঁস ৫টি, মেরী হাঁস ১৭টি, কবুতর ১৫ টি।
প্রতি মাসে সবজি ফসলের পাশাপাশি প্রাণীসম্পদ পালনেও আয়ের একটি বড় অংশ আসে। বছরে প্রাণী সম্পদ পালন করে প্রায় এক লাখ টাকার উপর আয় হয়। বাড়িতে যেমন স্থানীয় হাঁস-মুরগি, ছাগল-ভেড়া ও গরু পালন করেন তেমনিভাব ব্যবসায়িকভাবে লেয়ায় মুরগির একটি ফার্মও তৈরি করেছেন। সবজি ও মাছ চাষে বেশির ভাগ জৈব পদ্ধতি ব্যবহার করেন। ফসল চাষের জন্য বাড়ির গোবর যেমন ব্যবহার করেন তেমনি হাঁস-মুরগি, ছাগল ভেড়ার বিষটাও সার হিসাবে ব্যবহার করেন। এছাড়াও ফসলের পোকা দমনের জন্য নিম পাতা, মেহগনির পাতা, তামাক, গুল, ও ছাই ব্যবহার করেন।
কৃষক দম্পতি জানান, ‘আমরা যেহেতু যৌথ পরিবারের সদস্য সেক্ষেত্রে বাড়ির সকলে কম বেশি করে কৃষি কাজে সময় দেন। তবে বেশিরভাগ সময়টা আমরা দিই। বাড়ির কোন অংশ আমরা ফেলে রাখিনা। সব জায়গায় কোন না কোন ফসল লাগানোর চেষ্টা করি। ক্ষেতে সবজির পাশাপশি বাড়িতের ছাদে, পুকুরের ঘাটে বস্তা ও ক্যারেট পদ্ধতিতে বর্ষার ও শীতের সময় বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষাবাদ করি। বাড়িতে যে সবজি উৎপাদন হয় তা যেমন বাজারে যেয়ে বিক্রি করি তেমনি বাড়ি থেকে অনেকে এসে নিয়ে যায়। এছাড়াও আমাদের বিভিন্ন পার্বণে যে শাকের দরকার হয় তা গ্রামের প্রায় মানুষ আমাদের বাড়ি থেকে নিয়ে যায়।’ তারা আরও জানান, ‘বসতভিটার চারপাশে লবণ পানি হওয়ার পরও আমরা বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষ করার চেষ্টা করি। এ কাজটি আমরা পূর্ব পুরুষের সময় থেকে করে আসছি। আমাদের এখানে সুপেয় পানির বড় সমস্যা। এই পানির সমস্যা না থাকলে সকল পরিবারে বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষ করতে পারতো।’
তারা বলেন, ‘এক সময় আমাদের বাড়িতে রাজঘুমুক চাষ হতো। এখনও যদি বীজ পাই তাহলে লাগিয়ে দেখতে পারি। আমরা সব সময় পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে সব কিছু লাগানোর চেষ্টা করি। আমাদের বাড়িটি একটি বৈচিত্র্যময় কৃষিবাড়ি। আমাদের শুধু মাত্র তেল, লবণ ও কিছু মসলা বাজার থেকে কিনতে হয়। সব কিছু আমাদের বাড়িতে পাওয়া যায়। খাদ্য পুষ্টির উৎস হলো আমাদের এই বাড়ি।’
এই কৃষক দম্পতি প্রতিবছর যে সব ফসল চাষাবাদ করেন সেসব ফসলের বীজর সংরক্ষণে রাখেন। প্রতি মৌসুমের ১৫-২০ জনের মাঝে বীজ বিতরণ করেন। তাদের বাড়িতে কচুরমুখি, আলু, ওল, পুঁইশাক, শসা, লাউ, ঢেড়স, লালশাক, তরুল, ঝিঙা, পেপে, বরবটি, ঝাল, আদা ও হলুদেও বীজ সংরক্ষণে রাখেন। তাদের বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা আসেন। সবজি চাষের সফলতা দেখে কিছু প্রতিষ্ঠান সহায়তা করেছে। সে অনুযায়ী বারসিক’র শতবাড়ির তৈরির জন্য তাদের বাড়িটি নির্বাচন করেছে। বারসিক থেকে শতবাড়ি উন্নয়নে ধারাবাহিক সহায়তা ও যোগাযোগ চলমান রয়েছে।
সঠিক পরিকল্পনা আগ্রহ উদ্দীপনার মাধ্যমে কৃষিকে আগলে রেখে অনেক পরিবার সফলতার সাথে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছেন। তেমনই এক দম্পতি পরিমল ও বিজলী রানী জোয়ারদার। তাদের কাজকে সঠিক মূল্যায়নের মাধ্যমে কাজের গতিশীলতা আনয়নে প্রয়োজনীয় সহায়তা করা হলে একটি আদর্শ কৃষিপরিবেশ সেন্টার তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে।