২১ ধরনের চুলা তৈরি করতে পারেন স্বপ্না আক্তার
নেত্রকোনা থেকে পার্বতী রানী সিংহ
কৃষি প্রতিবেশবিদ্যা প্রাণবৈচিত্র্যনির্ভর বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষি পদ্ধতি ও খাদ্যব্যবস্থাপনা যা অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক, জলবায়ু সহিষ্ণু এবং সামাজিক ন্যায্যতার ভিত্তিতে পরিচালিত। জলবায়ু পরির্বতনজনিত কারণে বিপন্ন মানুষের সামগ্রিক অধিকার সুরক্ষা করা ন্যায্যতার অন্যতম শর্ত, যা কৃষি প্রতিবেশ বিদ্যার চর্চার ভিতর দিয়েই করা সম্ভব।
এই চর্চাগুলো আমাদের গ্রামীণ সমাজে প্রজন্মের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে পরিবর্তীত পরিবেশের পরিবর্তনশীলতার মধ্যে দিয়ে আজও বহন করে চলছে।
ইতিহাসের সময়ের প্রতিটি পাতায় পাতায় বেঁচে থাকার জন্য গ্রামীণ নারীর জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, চর্চা স্বাক্ষ্য বহন করে চলছে। অস্থিতিশীল অর্থনীতি,জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় নিজেদের টিকিয়ে রাখতে গ্রামীণ নারীরা তাদের নিজেদের চর্চা, অভিজ্ঞতাকে আরো গঠনমূলকভাবে অর্থ্যাৎ আধুনিক পদ্ধতির সাথে নিজেদের অভিজ্ঞতা ও চর্চার সমন্বয় করে টিকে থাকার লড়াই করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
কৃষি সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়ে আসছে আমাদের গ্রামীণ নারীরা তাদের নিত্যদিনের কাজ, নিজস্ব জ্ঞান ,অভিজ্ঞতা, লোকায়ত চর্চার মধ্য দিয়ে পরিবর্তনশীল পরিবেশে যেমন কৃষিকে করছে সমৃদ্ধ তেমনি নিজেদের টিকে থাকার কৌশল আয়ত্ব করছে প্রতিনিয়ত। গ্রামীণ নারীর চর্চা যেমন কৃষিকে সমৃদ্ধ করছে তেমনি ব্যয় সাশ্রয়ী অর্থনীতেতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। পরিবারের প্রতিটি ব্যবহৃত উপকরণ নিজেদের স্থানীয় প্রাকৃতিক সম্পদ দিয়ে তৈরি করে স্থায়িত্বশীল ও পরিবেশবান্ধব জীবনযাপন করে যাচ্ছেন।
দূর্গাশ্রম গ্রামের নারী স্বপ্না আক্তার (৩৫) পিতা: মো: গোমেজ। তিনি এক সন্তানের জননী। কৃষক পরিবারে জন্মসূত্রে কৃষিকাজের সাথে সেই ছোট বেলা থেকেই যুক্ত। মায়ের কাছে মাটির চুলা তৈরি হাতেখড়ি। সেই থেকে মাটি দিয়ে চুলা তৈরির শখ এখন দক্ষতার রূপ নিয়েছে। পরিবেশবান্ধব চর্চাকারী স্বপ্না আক্তার মাটির চুলা ও হাজল তৈরিতে দক্ষতার সাথে বহু বছর যাবৎ নিজের অবসর সময়ে নানান ধরনের চুলা তৈরি করে আসছেন। জ্বালানির ভিন্নতার, বিভিন্ন সময়ের জ্বালানির প্রাপ্যতা, আবহাওয়া, জায়গা বিবেচনা উপর ভিত্তি করে চুলার নকঁশা, আকার , উচ্চতা, ধরন ভিন্ন হয়ে থাকে। তার দক্ষতার উপর ভিত্তি করে প্রায় ২১ ধরনের চুলা তৈরি করতে পারেন।
আমাদের গ্রামীণ নারীরা নিজেদের বিনোদন খুঁজে নেন নিজেদেরে শৈল্পিক সত্তার বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে সেটা হতে পাতে পারে পরিবারের আসবাপত্র তৈরি ,কাথাঁ, রুমাল, ঘর সাজানোর উপকরণ বা চুলা তৈরির ভেতর দিয়ে। স্বপ্না আক্তারও তার অবসর সময়টুকু মাটির চুলা তৈরি করে কাটান। গ্রামে পরিবেশবান্ধব চুলার কারিগর হিসাবে বেশ সুপরিচিত। এখন পযর্ন্ত প্রায় ৩০০ চুলা তিনি তৈরি করে প্রতিবেশীদের দিয়েছেন।
যেমন গর্তচুলা, লঞ্চচুলা, বন্ধুচুলা, শিক চুলা, গাইন চুলা, খড়ির চুলা, গইডাচুলা, মিছাচুলা, চৌকারী চুলা, তুষের চুলা, ইটাচুলা, সিঙ্গরা চুলা, টেডি চুলা, ডহি চুলা, লাভচুলা, বন চুলা, দোতালা চুলা, নাইক্যাচুলা, দুমুখী গাইন চুলা,পাতার চুলা,তিনমুখ চুলা। প্রতিটি চুলায় রয়েছে আলাদা গঠনগত বৈশিষ্ট্য ধরন ও জ্বালানির ভিন্নতা।
পরিশেষে কৃষি প্রতিবেশ বিদ্যা শুধু বাস্তুতন্ত্রের বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে প্রতিবেশীয় সম্পর্ক ও কৃষি ফসলের সাথে পরিবেশের আন্তঃসম্পরর্কের বিদ্যানির্ভর নয়, যা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নিজস্ব জ্ঞান, চর্চা, সংস্কৃতি, প্রথা ও পছন্দকে স্বীকৃতি দেয়। সেক্ষেত্রে স্বপ্না আক্তারের চর্চা আমাদের কৃষি প্রতিবেশ বিদ্যার এক অনন্য উদাহারণ, যা নারীর অধিকার সুরক্ষায়, জলবায়ু ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখবে।