সাম্প্রতিক পোস্ট

মানিকগঞ্জের সিংগাইর এলাকার গ্রামীণ নারীর সংগ্রাম, সফলতা ও সম্ভাবনা

সিংগাইর, মানিকগঞ্জ থেকে রিনা আক্তার

ভূমিকা

নারীর সমমর্যাদা ও সমাধিকার ছাড়া একটি জেন্ডার সংবেদনশীল, বহুত্ববাদী সমাজ গঠন সম্ভব নয়। নারীর প্রতি সকল প্রকার সহিংসতা বন্ধ করে তাদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় বারসিক মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর পৌরসভা ও বায়রা ইউনিয়নের ১৫টি গ্রামে সরাসরি কাজ করছে। এই কার্যক্রমে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে যুবসমাজকে, কারণ তাদের সচেতনতা ও সম্পৃক্ততা সমাজে জেন্ডার সমতা প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে পারে।

সমাজের আগ্রহী তরুণ-তরুণী, নারী-পুরুষ, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষকে এই প্রক্রিয়ার অংশ করে তোলার জন্য আলোচনা সভা, প্রশিক্ষণ, প্রচারাভিযান এবং কর্মশালা আয়োজন করা হয়। পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি সেবা প্রাপ্তিতে নারীদের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধিতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। এই উদ্যোগগুলোর মাধ্যমে পরিবর্তনের ধারাগুলো এখানে তুলে ধরা হলো:

জনসচেতনতা জেন্ডার সংবেদনশীল আচরণ

কিশোর-কিশোরী সংগঠন, নারী সংগঠন, যুব সংগঠনের মাধ্যমে গত এক বছরে ৪৫টি মাসিক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভাগুলোর মাধ্যমে বাল্যবিবাহ, যৌন হয়রানি, প্রজনন স্বাস্থ্য, পারিবারিক কৃষি, এবং জেন্ডার সমতার মতো বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা হয়। অন্যদিকে গণপরিবহনে যৌন হয়রানি বন্ধে চালক, হেলপার, ট্রাফিক পুলিশ ও যাত্রীদের নিয়ে আলোচনা করা হয় এবং নারীদের সুরক্ষায় স্টিকার লাগানো হয়। ফলশ্রুতিতে সিংগাইর এলাকায় গণপরিবহনে নারী নির্যাতনের ঘটনা শূন্যে নেমে এসেছে। এছাড়া কিশোরী সংগঠনগুলো ‘গুড টাচ-ব্যাড টাচ’ বিষয়ে ৭টি সভা আয়োজন করেছে। এতে অংশগ্রহণকারীরা নিজেদের সচেতন করার পাশাপাশি পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরও সচেতন করতে সক্ষম হয়েছে।

বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ

প্রকল্পের আওতায় ১৫টি নারী সংগঠন, ৭টি কিশোরী সংগঠন এবং ২টি যুব সংগঠন সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। কর্মশালার ফলে কমিউনিটি পর্যায়ে জেন্ডার বিষয়ে সচেতনতা তৈরি হয়। সংগঠন পর্যায়ে মাসিক সভা,কর্মশালা ও বিণিভন্ন ধরনের প্রচারণার ফলে বাল্যবিয়ে, যৌন হয়রানি সামাজিকীকরণ, জেন্ডার বৈষম্য সম্পর্কে ধারণা লাভ করেছে এবং সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক বৃদ্ধি পেয়েছ্। যার ফলে সদস্যরা একে অপরের বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়ায় । তাদের মধ্যে পারস্পরিক  যোগাযোগ ও তথ্যবিনিময় বেড়েছে। গত এক বছরে এই সংগঠনগুলোর প্রচেষ্টায় ২৪টি গ্রামের শতাধিক পরিবারে কোনো বাল্যবিয়ে হয়নি। অনামিকা সরকারের উদাহরণ উল্লেখযোগ্য, যার বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে কিশোরী ক্লাবের সদস্যরা কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। অংকুর কিশোরী ক্লাবের অনামিকা সরকার ৯ম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় যার বিয়ে ঠিক হযে যায়। কিশোরী ক্লাবের সদস্যরা ঘটনাটি জানার পর নিজেদের মধ্যে আলোচনা কর এবং পরবর্তীতে তার পরিবারের সাথে কথা বলে বাল্যবিয়েটি বন্ধ করতে সক্ষম হয়। অনামিকা বর্তমানে একাদশ শ্রেণীতে অধ্যায়নরত। বর্তমানে অনামিকার মত কিশোরীরাই নিজেদের সাফল্যকে সকলের সামনে তুলে ধরা সমাাজ পরিবর্তনে এক একজন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে উঠছে। তারা হয়ে উঠছে জেন্ডার সংবেদনশীল সমাজ গঠনের এক একজন এজেন্ট।

সেবা পরিসেবায় নারীর সম্পৃক্ততা

কর্মএলাকায় সরকারি ও বেসরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নারীরা মাতৃত্বকালীন ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা এবং বিভিন্ন দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছে। প্রকল্পের কর্মএলাকায়  ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, সমাজসেবা অধিদপ্তর , জাতীয় মহিলা সংস্থা,  যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, কৃষি ও সমবায় অধিদপ্তরসহ সরকারি-বেসরকারি সেবাদানকারি প্রতিষ্ঠানে সেবায় নারীদের সম্পৃক্ততা বেড়েছে। ৩০ জন নারী প্রশিক্ষণ শেষে সরকারি ঋণ সুবিধা লাভ করেছেন।

নারী নেতৃত্ব স্বীকৃতি

আন্ত:প্রজন্ম সংলাপে নবীন-প্রবীন সমন্বয়ে অভিজ্ঞতা বিনিময়য়ের মাধ্যমে  সামাজিক দায়-দায়িত্ব, সামাজিক বন্ধন , পারস্পরিক সহমর্মিতা, প্রাণ-প্রকৃতি সংরক্ষন, লোকায়ত জ্ঞান, বহুত্ববাদিতা, জলবায়ু পরিবর্তন,  ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করা হয্। সংলাপে অংশগ্রহনকারীরা সামাজিক সম্প্রীতির সংস্কৃতি  রক্ষা,বহুত্ববাদি সমাজ বিনির্মানে এবং প্রকৃতি সংরক্ষনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেন। এ সকল সংলাপে দেশীয জাতের ফলজ, বনজ বৃক্ষ বিনিময় করা হয়্। যার ফরে প্রকৃতিতে বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।  আন্ত:প্রজন্ম সংলাপ আয়োজনের ফলে সামাজিক সম্প্রীতি ও বৈচিত্র্য রক্ষা হচ্ছে। সদস্যরা  একটি লক্ষে আন্ত:নির্ভরশীল ও বহুত্ববাদি সমাজ বিনির্মানে ভুমিকা রাখছে।  সংগঠন পর্যায়ে সংগঠন শক্তিশালীকরণ , নেতৃত্ব বিকাশ , জীবন দক্ষতা বিষয়ক সভা ও কর্মশালার আয়োজন করা হয়্। ৯টি আন্তঃপ্রজন্ম সংলাপের মাধ্যমে নবীন ও প্রবীণদের মধ্যে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। সামাজিক দায়িত্ব, প্রকৃতি সংরক্ষণ, এবং বহুত্ববাদী সমাজ গঠনের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ৩ জন নারী “জয়িতা” সম্মানে ভূষিত হয়েছেন।

উপসংহার

যদিও সমাজে অসচেতনতা, কুসংস্কার এবং পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা রয়েছে, তবুও সচেতন যুবসমাজ এবং আগ্রহী মানুষের প্রচেষ্টায় ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটছে। এই পরিবর্তনগুলো সমাজে অবহেলিত নারীদের ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি জোগাচ্ছে। তাই জেন্ডার সংবেদনশীল সমাজ গঠনে আরো বেশি মানুষের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা জরুরি।

happy wheels 2

Comments