প্রাকৃতিক সাবান শিমুল ফুল
আটপাড়া,নেত্রকোনা থেকে হেপী রায় ::
বাংলাদেশের প্রকৃতির এমনই এক মোহময় রূপ রয়েছে যা মানুষকে অভিভূত করে আবার উপকার সাধন করে। যে কোন মানুষ তার নান্দনিক রূপে আকৃষ্ট হয়। এমনকি প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে নিজেদের প্রয়োজন মতো সামগ্রী তৈরি করে। এমনই একটি প্রাকৃতিক উপাদান হলো শিমুল ফুল। এই সময়ে অর্থাৎ শীতের শেষ এবং বসন্তের শুরুতে প্রকৃতিতে যে আবহ বিরাজ করে, তাতে মনটা কেমন যেন একটু উদাসীন হয়ে যায়। আবার শরীরেও আসে একরকম অলসতা। এসময় ফুল, পাখির কিচির মিচির পরিবেশের স্নিগ্ধতায় নিজের অজান্তেই মনটা ভালো হয়ে যায়। শীতকালের শেষের দিকে যখন শিমুল গাছে ফুল ফোটে তখন দূর থেকে চোখ পড়ে গাছটার দিকে। টকটকে লাল রঙের শোভা দেখে মানুষ মুগ্ধ হয়। গ্রামবাংলার পথে প্রান্তরে অসংখ্য শিমুল গাছ সারাবছর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে। দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এই গাছই এক সময় আগুন ঝরা রূপে প্রস্ফুটিত হবে। শিমুলের রূপ একদিকে যেমন মানুষকে বিমোহিত করে, তেমনি অন্যদিকে উপকারও সাধন করে। এর তুলা পাওয়া যায়, আবার এই ফুল দিয়ে কাপড় কাঁচার পাউডার তৈরি করা হয়।
আজকের এই আধুনিক যুগের নিত্য নতুন ডিটারজেন্ট পাউডার এবং বল সাবানের ভিড়ে কিসমত আড়া গ্রামের জহুরা বেগম হারিয়ে যেতে দেননি তার দাদীর কাছ থেকে শেখা কাপড় কাঁচার কৌশল। দাদী যখন বাড়ির আশেপাশে শীত মৌসুমে শিমুল ফুল কুড়াতে যেতেন তখন সঙ্গী হতো ছোট্ট জহুরা। ফুল কুঁড়িয়ে দিয়ে দাদীর কাজে সাহায্য করতো। কে জানতো শখের বশে শেখা জ্ঞান একদিন তার সাংসারিক জীবনে কাজে আসবে। মগড়া নদীর তীর ঘেঁষে কিসমত আড়া গ্রাম। সেই গ্রামে আছে নানা প্রকার ফুল ফল ও সবজির গাছ। শিমুল ফুল গাছেরও অভাব নেই। শীত মৌসুমে অর্থাৎ ফাল্গুন/ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসের দিকে লাল লাল ফুল নিয়ে হরেক রকম গাছের ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকে শিমুল গাছ। কোনটির আবার হলুদ রঙের ফুলও ফোটে।
কিভাবে সাবান তৈরি করা যায়
গাছের নিচে পড়ে থাকা শিমুল ফুল সংগ্রহ করার পর অনেকগুলো ফুল একত্রিত করে পরিষ্কার জায়গায় রৌদ্রে শুকিয়ে নেয়া নিতে হবে। ফুলগুলো ভালোভাবে শুকালে তাতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ছাই করতে হয়। এই ছাই অল্প একটু চুন দিয়ে বা চুনের পানি দিয়ে মন্ড বানিয়ে মাটির হাঁড়ি অথবা কাগজে মুড়িয়ে কোন শুষ্ক জায়গায় রেখে দিতে হয়। তবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে এই তৈরিকৃত মন্ডে বাতাস না লাগে। কারণ বাতাস লাগলে এর কাপড় পরিষ্কার করার ক্ষমতা বা গুনাগুণ নষ্ট হয়ে যায়। শুষ্ক অবস্থায় থাকলে এই মন্ড অনেকদিন সংরক্ষণ করা যায়। পরে প্রয়োজন মতো নিয়ে কাপড় ধোয়ার জন্য ব্যবহার করা যায়।
কি কি কাপড় কাঁচা যাবে
নতুন কোন কাপড় ছাড়া পুরনো সব কাপড়ই কাচা যাবে। নতুন কাপড়ের রঙ উঠে যাওয়ার ভয় থাকে। কাঁথা, বালিশের কভার, বিছানার চাদর, মশারি ইত্যাদি বেশি ময়লা যুক্ত পুরানো কাপড় কাচার জন্য এটি অত্যন্ত উপযোগী। কাপড় কাচার সাবান অথবা সোডার চাইতেও এর কাপড় পরিষ্কার করার ক্ষমতা অনেক বেশি বলে কিসমত আড়া গ্রামের জহুরা বেগম জানান।
কাপড় কাঁচার পদ্ধতি
পানি খুব ভালোভাবে গরম করে অল্প পরিমাণ যেমন এক মুঠো মন্ড সেই পানিতে গুলে নিতে হয়। মন্ডটি ভালোমতো পানিতে মিশে গেলে আরো কিছুক্ষণ জ্বাল করে তাতে ময়লা কাপড়গুলো ভিজিয়ে রাখতে হয়। মূলত এসব কাপড় এক ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হয়। তারপর তুলে নিয়ে ভালো করে আছড়ে পরিস্কার পানিতে ধুয়ে নিলেই পাওয়া যাবে কাক্ষিত পরিষ্কার কাপড়। শিমুল তুলার বাকল দিয়েও একই প্র্রকারে কাপড় পরিষ্কার করা যায়। তবে বৃষ্টিতে ভিজার আগেই সেগুলো সংগ্রহ করতে হয়। বৃষ্টিতে ভিজলে এর গুনাগুণ নষ্ট হয়ে যায়। কিসমত আড়া গ্রামের একমাত্র জহুরা বেগমই এই পদ্ধিতে কাপড় পরিস্কার করেন। তিনি বলেন, “যতই বাসওলা (সুগন্ধি) সাবান থাকুক এইডা ছাড়া কাপড় পরিস্কার করলে আমার মন উডেনা (ভরেনা)। আমি আমার ছেলের বৌরেও শিখাইছি। এখন বেশির ভাগ কাজই সে করে।”
কাপড় ধোয়ার এই লোকায়ত পদ্ধতি যেন শুধুমাত্র জহুরা বেগমের পরিবারেই সীমাবদ্ধ না থাকে। তিনি যেমন তার ছেলের বৌকে শিখিয়েছেন, তেমনি এই পদ্ধতি একজন থেকে অনেক জনের মাঝে ছড়িয়ে যাবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। এক্ষেত্রে জহুরা বেগমের এই লোকায়ত চর্চাকে গ্রামের অন্য নারীদের সাথেও সহভাগিতা করার উদ্যোগ নিতে হবে।