আলোর ফাঁদে ফসল সুরক্ষা
দেবদাস মজুমদার, বিশেষ প্রতিনিধি, উপকূলীয় অঞ্চল
পোকামাকড় ফসলের রোগ ব্যাধি বাড়িয়ে দেয়। ক্ষতিকর পোকার আক্রমণে কৃষি জমির ফসল বিনষ্ট হয়। কৃষককে তাই ফসলের মৌসুমে পোকামাকড় দমন করা জরুরি হয়ে পড়ে। ফসলের ক্ষেতে ক্ষতিকর পোকা মাকড়ের উপস্থিতি জানা যেমন কৃষকের জন্য জরুরি তেমনি ফসল বিনষ্টকারী পোকা দমনে সময়মত নানা বালাইনাশক ব্যবস্থাও নিতে হয় কৃষককে। আমাদের ফসলে রাসায়নিক বিষ দিয়েই ফসলের পোকা দমন করা হয়। কৃষি জমিতে যথেষ্ট পরিমাণে রাসায়নিক বিষ ব্যবহারের ফলে পরিবেশেরও ক্ষতি হয়। আবার কীটনাশক ঔষধ যথেচ্ছ ব্যবহার আমাদের দেশী প্রজাতির মাছের বংশ বিস্তারে অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতিরিক্ত বালাইনাশক ব্যবহারের ফলে আমাদের কৃষি ও জনজীবনসহ প্রাণবৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। ফলে পারিবেশবান্ধব কৃষি সম্প্রসারণ এখন জরুরি।
অনেকসময় কৃষক কৃষিজমিতে পোকার উপস্থিতি না বুঝে পোকা মাকড় দমনে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়। এ ক্ষেত্রে ফসল সুরক্ষায় আবাদী জমিতে পোকার উপস্থিতি জানা অত্যন্ত জরুরি বিষয়। ধান ক্ষেতে ক্ষতিকর পোকার উপস্থিতি ও ক্ষতিকর পোকা চিহ্নিতকরণের সহজ পদ্ধতির নাম আলোক ফাঁদ। উপকূলীয় পিরোজপুর অঞ্চলের কৃষকের কাছে ফসলের পোকার উপস্থিতি যাচাইয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে পরিবেশবান্ধব এই আলোক ফাঁদ। কৃষি বিভাগের উদ্ভাবিত পরিবেশবান্ধব এই পদ্ধতি ব্যবহার করে আমন ফসলে পোকামাকড়ের উপস্থিতি যাচাইয়ে কৃষকরা এই আলোক ফাঁদ পদ্ধতি ব্যবহারের অধিক সচেতন হয়ে উঠছেন।
রাতের পোকামাকড় আলোক স্পর্শী। আলোর কাছে এসে জড়ো হয় কীটপতঙ্গ। ফসলের মাঠের কাছে আলো জ্বালিয়ে তার নিচে সাবান পানির গামলা বসিয়ে ফসলের পোকামাকড় নিজেরাই ধরছেন কৃষক। তারপর সেইসব পোকা পর্যবেক্ষণ করে ফসলের মাঠের রোগবালাই সম্পর্কে ধারণা নিতে পারছেন কৃষক। সে অনুযায়ী স্থানীয় কৃষি বিভাগের কর্মর্তাদের কাছে পরামর্শ নিয়ে ফসলে পোকা দমনে কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছেন তারা। এ পদ্ধতিতে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া, কাউখালী ও ভা-ারিয়ার কৃষকরা এই পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি ব্যবহার করে সুফল পাচ্ছেন। আলোর ফাঁদ পদ্ধতি ব্যবহারের কৃষকদের সচেতন করতে ইতিমধ্যে কৃষি বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে রাতের আঁধারে ফসলের মাঠে গিয়ে সরাসরি কৃষকদের আলোক ফাঁদ পদ্ধতি ব্যবহারে প্রশিক্ষণ প্রদান করছেন। এ পদ্ধতি সম্প্রসারণে কৃষি বিভাগ থেকে কৃষকদের মাঝে সোলার প্যানেল সহায়তা দিচ্ছেন। ফলে কৃষকের এই পদ্ধতি ব্যবহারে বাড়তি খরচেরও কোন ঝামেলা নেই। এর ফলে কৃষকরা তাদের আমন ফসলের ক্ষেতে ক্ষতিকর পোকার উপস্থিতি নিজেরাই নিরূপণ করে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের পরামর্শে বালাই দমনে আগাম প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছেন। আবার এ আলোক ফাঁদ পদ্ধতি ব্যবহারের ধান ক্ষেতের ক্ষতিকর পোকা দমনে খরচও কমে গেছে। আলোক স্পর্শী পোকামাকড় আলোক ফাঁদে এসে খুব সহজেই মারা পড়ছে। ফলে ক্ষতিকর পোকা দমনে মাত্রারিক্ত রাসায়নিক ঔষধ ব্যবহারের পরিমাণ কমতির দিকে।
আলোক ফাঁদ (লাইট ট্রাপ)
ফসলের পোকামাকড় আলোতে আকৃষ্ট হয়। এসব পোকা ধরার জন্য মশাল হেজাক লাইট, চার্জার, বৈদ্যুতিক বাতি প্রভৃতি ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। বাতি ধান ক্ষেতের পাশে ঝুলিয়ে বাতির নিচে গর্ত কিংবা একটি পাত্রে সাবান পানি বা কেরোসিন মিশ্রিত পানি রাখলে পোকা সেখানে আটকে যাবে। অন্ধকার রাতেই আলোক ফাঁদ ব্যবহার করতে হয়। তবে জোৎস্না রাতে এটি কার্যকর নয়। ্মঠবাড়িয়া উপজেলার তুষখালী কৃষি ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সুমন কুমার কর্মকার বলেন, “আলোক ফাঁদ দিয়ে ফসলের মাঠে অনিষ্টকারী পোকা নির্ণয় করা সহজ। আবার ক্ষতিকর পোকা দমনও করা যায়। আলোক ফাঁদ ফসলের মাঠ থেকে কিছুটা দূরে রাখতে হয়। একই মাঠে সব কৃষক মিলে এটি ব্যবহারে বেশি সুফল পাওয়া যায়। সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টার মধ্যে আলোক ফাঁদ ব্যবহার করতে হয়।
এ আলোক ফাঁদ দিয়ে যে সকল পোকা নির্ণয় ও দমন করা যায় সেগুলো হলো: উড়চুংগা. চুংগী পোকার মথ, সেমিলুপার মত, শুয়াপোকার মথ, গলমাছি, শীষকাটা লেদা পোকার মথ, রেদা পোকার মথ, মাজরা পোকার মথ, গান্ধী পোকা, কালো শোষক, বাদামী গাছ ফড়িং, সাদা পীঠ ফড়িং, সাদা ফড়িং, পাটটের বিছার মথ, বিভিন্ন ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকার মথ। এসব পোকা খুব সহজেই আলোক ফাঁদে এসে আকষ্ট হয়।
সরেজমিন পূর্ব তুষখালী
পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার তুষখালী ইউনিয়নের পূর্ব তুষখালী গ্রামে একটি কৃষি জমির মাঠের পাশে উপজেলা কৃষি বিভাগের উদ্যোগে সোলার প্যানেলের মাধ্যমে কৃষকদের আয়োজনে স্থাপন করা হয়েছিল আলোক ফাঁদ। স্থানীয় শতাধিক কৃষক আলোক ফাঁদ ঘিরে সমবেত হয়েছিলেন সেখানে। সোলার প্যানেলে জ্বলে ওঠা বাল্ব ঘিরে আলোক স্পর্শী পোকামাকড় ছুটে এসে আলোর নিচে পেতে রাখা গামলা ভর্তি সাবানের ফেনায় আটকে যাচ্ছিল। আলোক ফঁদে আটকে পড়া আমন ফসলের এসব পোকা কৃষকরা চিহ্নিত করেন। এরপর এসব পোকামাকড় নিয়ে স্থানীয় তুষখালী দাখিল মাদ্রাসা মাঠে কৃষকরা সমবেত হয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করে। এসময় বক্তব্য দেন, মঠবাড়িয়া উপজেলা কৃষি কর্মবকর্তা মো. মনিরুজ্জামান, উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সুমন কুমার কর্মকার, কৃষক মো. বশীর আহম্মেদ, হেমায়েত খান, হোসেন ঘরামী ও মালেক ফরাজি প্রমূখ ।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানাগেছে, এবার পিরোজপুর জেলার ১৫৯ টি কৃষি ব্লকে মোট ৬২ হাজার ৩০৭ হেক্টর আমন আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে জেলার মধ্যে মঠবাড়িয়া উপজেলা, পিরোজপুর সদর ও ভা-ারিয়ায় সবচেয়ে বেশি আমন আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে মঠবাড়িয়ায় উফশী আমন ৫ হাজার ২০০ হেক্টর ও স্থানীয় আমন ১৫ হাজার ১৭০ হেক্টর, পিরোজপুর সদর উপজেলায় উফশী আমন ৬৫০ হেক্টর, স্থানীয় ৯ হাজার ৫০০ হেক্টর, ভা-ারিয়া উপজেলায় উফশী আমন ১২৬ হেক্টর ও স্থানীয় আমন ৮ হাজার ১৮৬ হেক্টরে আবাদ হয়েছে। বর্তমানে ধানক্ষেতে ধানের চারায় ফলনের মৌসুম চলছে। সংগত কারণে এ সময় ধানের চারায় পোকার আক্রমণ শুরু হয়েছে। তাই কৃষকরা এখন ফসলের মাঠে ক্ষতিকর পোকা দমনে মহা ব্যস্ত সময় পার করছেন।
কৃষি বিভাগ পিরোজপুর অঞ্চলের কৃষকদের মাঝে আলোক ফাঁদ ব্যবহারের উদ্যোগী করতে নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। ফসলে পোকার উপস্থিতি জানতে আলোক ফাঁদ ব্যবহারে কৃষকদের উদ্যোগী করতে মাঠ পর্যায় কৃষকদের সন্ধ্যা রাতে সমাবেশের আয়োজন করে হাতে কলমে এ আলোক ফাঁদের ব্যবহার পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছেন। ফলে কৃষকরা সচেতন হয়ে উঠছেন। কৃষি বিভাগ পিরোজপুর জেলা ২৭০টি সোলার প্যানেল কৃষকের মাঝে বিতরণ করেছেন। এসব সোলার প্যানেলের মাধ্যমে কৃষকরা ফসলের মাঠে পোকার উপস্থিতি নিরুপণের পাশাপাশি তা দমনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন। আর এ আলোক ফাঁদের ব্যবহারের সাথে জেলার অন্তত ১৫ হাজার কৃষক সম্পৃক্ত হয়েছেন। প্রতিদিনই নতুন নতুন কৃষক এ কাজে সম্পৃক্ত হচ্ছেন।
মঠবাড়িয়ার তুষখালী গ্রামের কৃষক মো. হোসেন ঘরামি (৬৫) বলেন, “আলোক ফাঁদ ফসলের পোকার উপস্থিতি চেনা সহজ করে দিয়েছে। এতে কোন খরচ নাই। ধান ক্ষেতে কি ধরনের পোকার আক্রমণ হয়েছে তা সহজেই জানতে পারছি। আবার আলোক ফাঁদের মাধ্যমে পোকা দমন করতে পারছি। আলোক ফাঁদ পোকা দমনের একটি সহজ উপায়। যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারলে ফসলে কীট নাশকের মাত্রাও কমে যাবে আশা করছি।” মঠবাড়িয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. মনিরুজ্জামান বলেন, “ক্ষতিকর পোকা, আলোক ফাঁদ ধান ক্ষেতে পোকা দমনে একটি সহজলভ্য পদ্ধতি। পোকামাকড় লোক স্পর্শী বলেই সহজে আলোক ফাঁদে আটকে যায়। ধানের পোকার উপস্থিতি বুঝে কৃষক তা দমনের ব্যবস্থা নিতে পারছে। ফলে মাত্রাতিরিক্ত কীট নাশমক ব্যবহারও কমছে। আলোক ফাঁদ ব্যবহারে উপকূলের ধানক্ষেতে এবার পোকা মাকড়ের আক্রমন কম। আলোক ফাঁদ উপকূলের কৃষকের কাছে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।”
এ ব্যাপারে পিরোজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক কৃষিবিদ মো. আবুল হোসেন তালুকদার বলেন, “ফসলের মাঠে এখন ধানের কুশী বের হওয়ার সময়। এসময় ধানের খোলসে দুধ আসে। ক্ষতিকর পোকারা তা শুষে নেয়। এতে ফসল অপুষ্টিতে ভুগে কৃষকের ফসল মার খায়। তাই পোকা দমন অত্যন্ত জরুরি। আলোক ফাঁদের মাধ্যমে মূল ধান ক্ষেতে পোকার উপস্থিতি নির্ণয় করা হয়। এছাড়া ক্ষতিকর অনেক পোকাও দমন হয়। এটি পরিবেশবান্ধব একটি পোকা দমন প্রক্রিয়া। উপকূলের কৃষকরা আলোক ফাঁদ ব্যবহার করে ফসল সুরক্ষা করতে পারছেন।”