উপকূলীয় অঞ্চলে অচাষকৃত উদ্ভিদ বৈচিত্র্য ও তার ব্যবহার
শ্যামনগর সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল ও রামকৃষ্ণ জোয়ারদার
প্রকৃতির কোন উদ্ভিদই আগাছা নয়। হয় সেটা ঔষধি না হয় খাদ্যের বনজ উৎস। শুধু গ্রামে নয় বাংলাদেশের নগর, বন্দর, পাহাড়-পর্বত সব অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নিয়েছে অসংখ্য লতা, গুল্ম, শাক ও ভেষজ উদ্ভিদ। যার কোনটা খাওয়া যায় আবার কোনটা ঔষধি কাজে ব্যবহার করা যায়। এ সমস্ত উদ্ভিদ ব্যবহার, সংরক্ষণ ও বিকাশ নতুন প্রজন্ম তথা সকলের সচেতনতা জরুরি। অচাষকৃত উদ্ভিদ বৈচিত্র্য সংরক্ষণ, ব্যবহার বৃদ্ধি ও বিকাশের লক্ষ্যে এ উদ্ভিদ বৈচিত্র্যের পরিচিতি, ব্যবহার ও উৎপত্তিস্থল সংরক্ষণে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে আগ্রহী, সচেতন ও উদ্যোগী করে তুলতে বারসিক ২০১১ সাল থেকে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর পাশে থেকে ধারাবাহিক কর্মসূচি আয়োজন ও বাস্তবায়ন করে চলেছে।
অচাষকৃত উদ্ভিদ বৈচিত্র্য আলোচনায় প্রথমে ধারণা নেওয়া যাক। অচাষকৃত উদ্ভিদ বৈচিত্র্য আসলে কি? স্থানীয়দের মতে, যে উদ্ভিদ প্রাকৃতিকভাবে জন্মায়, যা চাষ করা হয় না অর্থ্যাৎ আজাবা, খুটে বা কুড়িয়ে পাওয়া যায় সে সকল উদ্ভিদকে অচাষকৃত উদ্ভিদ বলা হয়। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে দেখা যায় অচাষকৃত এ সকল উদ্ভিদের পাতা, কান্ড, মূল, শিকড়, বাকল, ফুল, ফল ও বীজ মানুষ ও গবাদি পশুপাখির খাদ্য হিসেবে ও চিকিৎসা কাজে ব্যবহার করে থাকে। স্থানীয় জনগোষ্ঠী উপকূলীয় অঞ্চলে এ সকল উদ্ভিদ প্রাপ্তির উৎস স্থল হিসেবে মনে করেন বসতভিটার চারপাশে পতিত ও অপতিত জায়গায় (সবজি ক্ষেতের পাশে, ঝোপঝাড়-জঙ্গল) প্রাকৃতিক জলাশয় (খাল, বিল, পুকুর, ডোবা-নালা) রাস্তার পাশে, গাছ, পুরাতন বাড়ি ও প্রাচীরের গায়ে, পুকুর পাড় এবং বন প্রভৃতি জায়গা। প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট, বাজার নির্ভর খাদ্য ব্যবস্থা, আবহাওয়া ও জলবায়ুগত পরিবর্তন, চিংড়ি ঘেরের প্রসার, লবণাক্ততার প্রভাব বৃদ্ধি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও ভূমির বিচিত্র ব্যবহারের ফলে দিনে দিনে ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে অচাষকৃত এই উদ্ভিদ বৈচিত্র্য। কিন্তু অঞ্চলভেদে এ সমস্ত উদ্ভিদ বৈচিত্র্যকে ঘিরে জীবন-সংস্কৃতি, সামাজিক ও ধর্মীয় রীতি-নীতি, উৎসব উদযাপন করা হয়। দৈনন্দিন জীবনযাপন, সামাজিক ও ধর্মীয় রীতি-নীতি, উৎসব ও সংস্কৃতিতে এ উদ্ভিদ বৈচিত্র্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যেমন কোন কোন অঞ্চলে নাইল্যা-গিমা-কলমিসহ নানান জাতের তিতা শাক খাওয়ার ভেতর দিয়ে শুরু হয় পয়লা বৈশাখ। অনেক অঞ্চলে জ্যৈষ্ঠ মাসে গিমাতিতা ও ওল খাওয়ার নিয়ম নেই। ফাল্গুনে গ্রামাঞ্চলে নানান জাতের শাক দিয়ে পালিত হয় আট আনাজ বর্ত। কোথাও আবার চৈত্র সংক্রান্তিতে তিতা স্বাদের শাক খাওয়ার নিয়ম নেই। কোন কোন অঞ্চলে কালো কচুশাক দিয়ে গছড়ি করে ধান রোপণ শুরু হয়। ধানের পাতা, কাদোফুল, দুপুর ফুল, সন্ধ্যামালতী ফুল, সাদা শাপলা, জবা ফুল, গোলাচি ফুল, তুলসী পাতা, দুর্বা পাতা, বেলপাতা দিয়ে তৈরী ‘ফুলঝাড়ি’ পূজার সময় অঞ্জলি দিতে ব্যবহৃত হয়।
উপকূলীয় অঞ্চলে উপরোক্ত লক্ষ্য অর্জনে বারসিক স্থানীয় জনগোষ্ঠীর পাশে থেকে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় যেমনঃ অচাষকৃত উদ্ভিদের তথ্য নথিভুক্তকরণ (পাসপোর্ট ডাটা, ছবি ও হার্বেরিয়াম) আলোচনা সভা, পাড়া মেলা, রান্না প্রতিযোগিতা, স্কুল পর্যায়ে কুইজ প্রতিযোগিতা, কবিরাজ কর্মশালা, কিশোর কিশোরী কর্মশালা আয়োজন, সংরক্ষণে (প্রদর্শনী প্লট তৈরী, হার্বেরিয়াম, ছবি, ফেস্টুন) আগ্রহী ও উদ্যোগী ব্যক্তিকে সম্মাননা/ সহযোগিতা করে চলেছে।
এই ধারাবাহিক কর্মসূচির মাধ্যমে উপকূলীয় সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলায় ৮৪ প্রকার আচাষকৃত উদ্ভিদ নথিভুক্ত হয়। যার মধ্যে ৩২ প্রকার উদ্ভিদ খাদ্য হিসেবেঃ শাপলা, দুধশাক/পেপেরোমিও, ঘুমশাক, কালোবনকচু, আদাবরুন, সেঞ্চি, ঘোড়া সেঞ্চি, থানকুনি, ক্ষুদকুড়ি, তেলাকচু, কাঁথাশাক/মাটিফোড়া, পেপুল শাক, কলমিশাক, বউটুনি, আমরুল শাক, হেলাঞ্চ, গাদামনি/নোনাগড়গড়ে, বেলে শাক, গিমে শাক, কাটানুটে, তালমাখনা, দুধ সেঞ্চি, গলগটে, পিপুল শাক, বেতো শাক, তিঁত বেগুন, হেগড়া, কুলফিনাড়ী, হিমশাক, ঢেঁকিশাক, হেটকেশাক, গন্ধ ভেজালী, এবং ৫২ প্রকার উদ্ভিদ চিকিৎসা কাজেঃ কালমেঘা, সাদা লজ্জাবতী, শীষ আকন্দ, হাতিশুঁড়, তুলসী, মিঠাইচন্দ্র, স্বর্নলতা/পরগাছা, ধুতরা, বুড়িপান, বনমূলা, দূর্বা, নয়নতারা, মণিরাজ, টোপাশ্যাওলা, রক্তকেউটে, সদাবদী, সেজী গাছ, রক্তকুচ, হাড়ভাঙ্গা, আগাছা, নিলার্জী, পাথরকুচি, আচ্ছটি, কুচট গাছ, রক্তকরবী, বামন আটি, দাউদকান্দি, রাখালচুটকি, কালকিসিন্দে, ভাটই, হরকোচা, কাকলে ঘাস/কানসুড়ি, কানালী ঘাস, অনন্তমূল, পাঁসাফুল, বুনো পালং, শিয়ালকাটা (বেগুনি), শিয়ালকাটা (হলুদ), শে^তআকন্দ, মুক্তঝুরি, জহরবাত, ফুলোটেপারি, অপরাজিতা, বাগঝাপা, শে^তক্রুপ, হুদো গাছ (গাছের উপর জন্মে), হুদো গাছ (নদীর ধারে জন্মে), বাসক, ছোচমুখী, আশফুল/বিষকাঁঠালী, গদগাছ, বিষকলমী ব্যবহৃত উদ্ভিদ হিসেবে নথিভুক্ত হয়।
অচাষকৃত উদ্ভিদ বৈচিত্র্য সমন্বয়ে ধারাবাহিক কর্মসূচিতে বারসিক স্থানীয় জনগোষ্ঠীর পাশে সহায়ক শক্তি হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। যার কারণে স্থানীয় জনগোষ্ঠীল মধ্যে অচাষকৃত উদ্ভিদ বৈচিত্র্যের ব্যবহার ও সংরক্ষণে জনসচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে, গড়ে উঠেছে উদ্ভিদবৈচিত্র্য সংরক্ষণে প্রদর্শনী প্লট। প্রতিদিনকার খাদ্য তালিকায়ও যুক্ত হচ্ছে এ উদ্ভিদ বৈচিত্র্য। যেখান থেকে নতুন প্রজন্ম এ সম্পর্কে ধারণা নিতে পারছে এবং সংরক্ষণে সচেতন হচ্ছে। বর্তমানে হাটে-বাজারে এ উদ্ভিদ বৈচিত্র্য বিক্রি হতেও দেখা যাচ্ছে। আমাদের আগামীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তাই জরুরি অচাষকৃত/আজাবা এই উদ্ভিদের জন্ম উৎস সংরক্ষণ ও ব্যবহার বাড়ানো।