কৃষিতে কৃষকের অধিকার, কৃষির সমৃদ্ধি
সিলভানুস লামিন
আধুনিক কৃষির ডামাডোলের মধ্যেও গ্রামবাংলার কিছু কৃষক এখনও হরেক রকমের ধানসহ নানান প্রজাতির শস্য-ফসল আবাদ করছেন। সাতক্ষীরার ফরিদা পারভীন, সিরাজুল ইসলাম, নিরঞ্জন জোয়ারদার, নেত্রকোনার সৈয়দ আহমেদ বাচ্চু, আবু সুফিয়ান, হালিম, গাইবান্ধার ইছামুদ্দিন মোল্লা, শফি-আলম, বরগুণার জাকির হোসেন, মোহাম্মদ সেকেন্দার, শামসুল হক, বাবুল হোসেনরা আবাদকৃত ফসল থেকে পরবর্তীতে চাষবাস করার জন্য বীজ নির্বাচন ও সংরক্ষণ করছেন। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে এলাকা উপযোগী জাত নির্বাচন ও সংগ্রহের জন্য গবেষণা করেন। তারা খরা ও লবণ সহনশীল ধান আবিষ্কার করতে যেমন সমর্থ হয়েছেন তেমনিভাবে স্বল্প সময়ের ঘরে তোলা যায় এমন ধানও আজ তাদের ঘরে রয়েছে। এসব কৃষকরা ফসলের জমিতে জৈব সার ব্যবহার করেন; বেশি উৎপাদনের নেশা তাদেরকে পেয়ে বসেনি! তাদের কাছে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা করাই প্রথম অগ্রাধিকার! কারণ তারা মনে করেন, মাটি সুস্থ থাকলে ভালো ফলন অবশ্যই আসবে।
আমরা জানি যে, মাটি হচ্ছে বর্জ্য ও ধুলোর মিশ্রণের সমন্বয়ে গঠিত উপাদান। মাটি হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম জীবন্ত বাস্তুসংস্থানও বটে। মাটিতে কোটি কোটি উদ্ভিদ, ব্যাকটেরিয়া, পোকামাকড়, ছত্রাক এবং অন্যান্য জীবন্ত প্রাণী রয়েছে। এসব অদৃশ্য প্রাণী, ব্যাকটেরিয়া, উদ্ভিদ মাটির জৈব উপাদান সৃষ্টিতে, গঠনে এবং বিশ্লেষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, যা মাটিকে সব সময় উর্বর রাখে। গ্রামবাংলার কিছু কৃষক মাটির সুরক্ষার মাধ্যমে বছর পর বছর জমিতে শস্য-ফসল আবাদ করছেন, সার-বিষের জন্য তাদেরকে হাহাকার করতে হচ্ছে না। Bangladesh Climate Change Strategy and Action Plan-2009-২০০৯-এ উল্লেখ করা হয়েছে যে, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন (কৃষি) তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বৃদ্ধি বা উন্নয়ন গস্খামবাংলার এসব কৃষকদের পরিশ্রমের ফসল, আত্মত্যাগের ফসল। অথচ বাংলাদেশে বর্তমানে অন্যতম প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে কৃষক অন্যতম। কৃষক এখন আর চান না তার ছেলে তার মতো করে কৃষিকাজ করুক! নানান বঞ্চনা, প্রতারণা, অবহেলা ও অস্বীকৃতির বেদনা-যন্ত্রণা থেকে কৃষক তার পেশা নিয়ে আজ আর গর্ব করতে পারছেন না! অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিলো না।
কৃষি থেকে কৃষককে বিতারিত করা, কৃষি থেকে কৃষকের অধিকার ছিনতাই, কৃষিখাতকে কৃষকের জন্য অলাভজনক খাত তৈরি করাসহ কৃষিকে নিয়ে বাণিজ্য করার পায়তারা শুরু হয়েছে মূলত ১৯৬০ সালের দিকে। আরও স্পষ্ট করে বললে উন্নিশ শতকের দিকে জার্মান রসায়নবিদ Justus Von Liebieg’র গবেষণা মডেলকে (উদ্ভিদ মাটি থেকে নাইট্রোজেন ফসফরাস ও পটাশিয়াম গ্রহণ করে কেবল, যদিও পরবর্তীতে তিনি স্বীকার করেছেন এ তিনটি ছাড়াও মাটি থেকে উদ্ভিদ আরও অনেক উপাদান গ্রহণ করে!) অনুসরণ করে বিশ্বব্যাপী আধুনিক কৃষি চর্চার পর থেকে কৃষির ওপর কৃষকের নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হতে শুরু করে। কৃষক নিজেদের লোকায়ত কৃষির চর্চার হাজার বছরের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাকে বাদ দিয়ে আধুনিক কৃষি চর্চা করতে শুরু করেন। তারা বাজার থেকে বীজ কেনেন, কেনেন সার, কীটনাশক এমনকি কৃষি অনুশীলনের সব ধরনের উপকরণই তাদেরকে কিনতে হয়!
আমাদের নীতিনির্ধারকগণ কৃষকদের ফুসলিয়ে, লোভ দেখিয়ে আধুনিক কৃষি চর্চা করতে কৃষককে উৎসাহিত করেন! তাঁরা কৃষকদের বলেন যে, এই কৃষি চর্চায় বাম্পার ফলন আসবে, কৃষক লাভবান হবেন, দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত হবে! কিন্তু তারা কখনও বলেননি, এই কৃষিচর্চার উৎপাদন খরচ বেশি, এই কৃষি অনুশীলনে রাসায়নিক সার, কীটনাশক, নিবিড় সেচ প্রয়োজন হবে। এ কৃষি অনুশীলনের পর থেকে রাসায়নিক সার ব্যবহার বেড়েই চলেছে। অন্যদিকে আমাদের দেশের নীতিনির্ধাকরা কৃষকদের বলেননি যে, এই কৃষিচর্চা পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্য ক্ষতিকর হবে, এই কৃষিচর্চায় কৃষকের স্থানীয় ও ঐতিহ্যবাহী জাতবৈচিত্র্য লোপ পাবে, তাদের স্থলে হাইব্রিড জাত ব্যবহৃত হবে! তারা বলেনি, এই কৃষিচর্চার এক পর্যায়ে কৃষি থেকে কৃষকের অধিকার সঙ্কোচিত হবে! কৃষক তাই হাজার বছরের পুরানো স্থায়িত্বশীল কৃষিচর্চা ফেলে রেখে, ঐতিহ্যবাহী স্থানীয় ফসলবৈচিত্র্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে তথাকথিত ‘নতুন উন্নত জাত’ দিয়ে চাষবাস করতে শুরু করে!
আধুনিক কৃষি চর্চার কয়েক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর কৃষকগণ আবিষ্কার করেন যে, আধুনিক কৃষিচর্চার কারণে কৃষিসংশ্লিষ্ট প্রায় প্রতিটি বিষয়েই তাঁরা পরনির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন, তারা আবিষ্কার করেন রাসায়নিক সার ব্যবহারের কারণে তাদের জমির উর্বরাশক্তি ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে, তারা দেখতে পাচ্ছেন ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন জাতবৈচিত্র্যও বিলুপ্ত হওয়ার পথে! উপরোন্তু তারা আবিষ্কার করছেন যে, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে তারা কৃষিতে আর লাভবান হচ্ছেন না! বরং দিনকে দিন তারা নিঃস্ব হচ্ছেন এবং তাদের পরিশ্রমের বদৌলতে বিশ্বের হাতে গোণা কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানি কোটি কোটি টাকার মুনাফা করছে! আর খাদ্য উৎপাদনের সাথে জড়িত থাকার পরও কৃষি পরিবার খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছে!
খাদ্য নিরাপত্তা বলতে খাদ্যের সহজলভ্যতা এবং এ খাদ্যের ওপর আমজনতার অভিগম্যতাকে বুঝায়। কিন্তু বাণিজ্যিক কৃষি মুনাফার জন্য রপ্তানিযোগ্য খাদ্য উৎপাদনের দিকেই বেশি জোর দিয়েছে; স্থানীয়ভাবে খাদ্যের সহজলভ্যতা এবং খাদ্যে সাধারণ মানুষের সহজ প্রবেশাধিকারকে তারা আমলে নেন না। অন্যদিকে খাদ্য উৎপাদনের প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে পুষ্টিকর খাদ্যের সহজলভ্যতা তৈরি করা; রপ্তানি বা বাণিজ্য করা নয়। কিন্তু আমরা কী দেখি? রপ্তানির জন্য খাদ্য উৎপাদন করতে গিয়ে পরিবেশ-প্রতিবেশের বিষয়টি কর্পোরেট কৃষির কর্তাদের চিন্তায় কখনও মূখ্য বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়নি। রাসায়নিক সার, কীটনাশক, ভূগর্ভস্থের পানি উত্তোলন, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের ভূমি দখল, বন উজাড় এবং জীবাশ্ম জ্বালানি ভক্ষণকারী যান্ত্রিক কৃষিউপকরণের বহুল ব্যবহারই হচ্ছে আধুনিক তথা বাণিজ্যিক কৃষির প্রধান বৈশিষ্ট্য। সাংস্কৃতিক খাদ্য উৎপাদন তো পরের বিষয় বরং বায়োফুয়েল উৎপাদনের জন্য কৃষিমাঠে সেসব শস্য-ফসল আবাদ করা হয় যেগুলো দিয়ে ওইসব জীবাশ্ম জ্বালানি তৈরি করা যায়।
বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়োফুয়েল উৎপাদনের জন্য বিশ্বের অনেক কৃষিজমিতে বাণিজ্যিকভাবে ‘Jatropha’ উৎপাদন বেড়ে গেছে। এছাড়া ১৫টি আফ্রিকান দেশের মিলিয়ন মিলিয়ন হেক্টর পরিমাণ জমিতে এই আগ্রাসী উদ্ভিদের উৎপাদন হচ্ছে! দেখা গেছে, রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও বাণিজ্যিক পণ্যের দামের কারণে কৃষকরা একদিকে যেমন দিশেহারা হচ্ছেন অন্যদিকে এসব উপকরণ ব্যবহারের কারণে তাদের জমি ধীরে ধীরে বন্ধ্যা হতে শুরু করেছে। কৃষিজমির ওপর কৃষকের নিয়ন্ত্রণ ও মালিকানাও আজ তাই অনেকটা বিপন্ন। বিশ্বে প্রতিদিন অনেক ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক তাদের চাষবাসের জমি হারাচ্ছেন! কারণ কৃষি উপকরণের উচ্চমূল্য এবং উৎপাদিত কৃষিজ ফসল বিক্রি করে লাভবান হতে না পারায় তারা ঋণগ্রস্ত হয়েছেন। ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে তারা শেষ সম্বলটুকু তথা জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। অনেকে কৃষি উপকরণের জন্য ঋণ নিতে গিয়ে পরিশোধ করতে না পারায় আত্মহত্যা করতে পিছপা হন না। ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কৃষকের আত্মহত্যার খবর আমরা জানি।
খাদ্য উৎপাদনের প্রাথমিক ও অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্ব থেকে ক্ষুধাকে বিতাড়িত করা এবং আধুনিক খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থা প্রবর্তনের মূল কারণটিও হচ্ছে ক্ষুধাকে বিতাড়ণ করা। কিন্তু বাস্তবতা অন্য কথা বলে! বাংলাদেশে এখনও দরিদ্র মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। Bangladesh Climate Change Strategy and Action Plan-২০০৯ অনুযায়ী দরিদ্র মানুষের এ সংখ্যা ৫০ মিলিয়নের মতো! বলা বাহুল্য যে, এ বিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে কৃষকদের সংখ্যাই বেশি!
কৃষিতে কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। এজন্য প্রয়োজন কৃষকের হাতে বীজ, সারসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণ সহজলভ্য করা। কৃষিচর্চার জন্য তারা যেন অন্যের মুখাপেক্ষী হতে না হয়। কৃষিতে কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে তাদের খাদ্য সার্বভৌমত্বও প্রতিষ্ঠিত হবে। কৃষক যদি কৃষিসংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, নিজস্ব পছন্দ অনুযায়ী চাষবাস করতে পারে, ভূমিসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদে তাদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত হলে তাঁরা কৃষির সমৃদ্ধি ও উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা যে রাখবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
কৃষিতে কৃষকের সত্যিকার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে তাদের চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক দেখা যাবে। মাঠে সোনালি ফসলের উপস্থিতি তাদেরকে নতুন সুন্দর স্বপ্ন রচনার উপলক্ষ তৈরি করে দেবে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার যে ৬টি স্তম্ভ’র ওপর গুরুত্বারোপ করেছে সেগুলোর একটি হলো কম কার্বন নিঃসরণ করে এমন উন্নয়ন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা। আমরা মনে করি, কৃষি উৎপাদনব্যবস্থায় সিরাজুল ইসলাম, নিরঞ্জন জোয়ারদার, সৈয়দ আহমেদ বাচ্চু, আবু সুফিয়ানরা যে লোকায়ত জ্ঞানভিত্তিক কৃষিঅনুশীলন করছেন সেটি কম কার্বন নিঃসরণ করে! তাহলে আসুন কৃষকের এই কৃষির উন্নয়নের উদ্যোগ নিই। এতে করে পরিবেশ যেমন রক্ষা হবে তেমনি কৃষিতেও কৃষকের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। কারণ কৃষিতে কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠাই কৃষিতে সমৃদ্ধি নিয়ে আসা সম্ভব হবে।