আমরাও পারি
:: রাজশাহী থেকে মো. শহিদুল ইসলাম::
ইচ্ছাশক্তি থাকলে তরুণরা যেকোন কাজ সম্পাদন করতে পারে, যেকোন সমস্যা সমাধানের পথ বাতলে দিতে পারে এবং যেকোন উন্নয়নমূলক উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পারে অন্যের ওপর নির্ভরশীল না থেকেই। নওগাঁর “বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কমিটি” সেটা প্রমাণ করলো। নিজেদের উদ্যোগে নিজেরাই বিভিন্ন সময় চাঁদা তুলে নানাধরনের উদ্যোগ বা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছেন এই সংগঠনের সদস্যরা। ইচ্ছাশক্তি ও উদ্যমের কাছে হার মানতে হয়েছে তাদের সামনে আসা বিভিন্ন ধরনের বাধা ও সমস্যাও। তাই তো তাদের এই মহৎ কাজের সাথে জড়িত হচ্ছে নানান পেশার ও শ্রেণীর মানুষ। কারণ শুরুতে এই সংগঠনের ব্যানারে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে শ্রী সুমন কুমার শীল’র নেতৃত্বে উক্ত ইউনিয়নের নাদবড় গ্রামের ২৫ জন তরুণ সরাসরি যুক্ত হলেও বর্তমানে (২০১৫) এই উদ্যোগের সাথে শামিল হয়েছেন আরও দু’টি উপজেলার (মহাদেবপুর, পতœীতলা) চারটি ইউনিয়নের (কাটিচোরা, মধুইল, হরিরামপুর এবং নজিপুর) ছয়টি গ্রামের (নাগড় দোলা, কাঞ্চন, আজইর, কদমছুড়ি, মিশন গ্রাম, বাদুর কলোনী) নানান পেশার ও বয়সের ৫৩ জন মানুষ। সংগঠনটি প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে বর্তমানে ৯টি গ্রামে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সচেতনতা তৈরি এবং সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখছে।
এখানে বলে নেওয়া দরকার যে, নওগাঁর পন্তিতলা উপজেলার নজিপুর সদর ইউনিয়নের আগ্রহী তরুণরা পাখি ও বন্যপ্রাণীর জন্য নিরাপদ প্রজনন ও আবাসস্থল নিশ্চিত করতে চান। তারা চান এসব বন্যপ্রাণী ও পাখিগুলো যেন নিরাপদে থাকে, বংশবৃদ্ধি করে পরিবেশকে ভারসাম্য রাখে। তাদের এই ইচ্ছা ও আগ্রহ বাস্তবতায় রূপ দেওয়ার জন্য তারা ২০১২ সালে গ্রামের পাশের বিলে পাখি শিকারীদের উৎপাত এবং বেআইনিভাবে পাখি শিকার বন্ধের জন্য মানববন্ধন, র্যালি, প্রচারণা এবং আলোচনা শুরু করেন। তাদের এই উদ্যোগের সাথে সংহতি প্রকাশ করেন এলাকার স্থানীয় মানুষও। ভালো কাজে সফলতা আসায় তরুণরা আরও উদ্যোগী হয়। সমাজে বিভিন্ন ধরনের অসঙ্গতি ও সমস্যা সমাধানের জন্য তারা সংগঠিত হয়ে গড়ে তোলেন “বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কমিটি” নামে একটি সংগঠন।
“বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কমিটি” মূল উদ্দেশ্য হলো প্রাণী ও পরিবেশ রক্ষা করা। সংগঠনের সদস্য এবং সভাপতি শ্রী সুমন কুমার শীলের (২৫) জানান, এই সংগঠনের মাধ্যমে তারা ক) বন্যপ্রাণী ও পশুপাখি শিকার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে প্রাণীদের জন্য নিরাপদ আবাসস্থল নিশ্চিত করা, খ) বন্য পশু পাখিদের খাদ্য, বাসস্থান, প্রজনন কেন্দ্র, পশুশুমারী, নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও সচেতনতা তৈরি করা এবং গ) পরস্পরের মধ্যে সদ্ভাব ও ভাতৃত্ববোধ গড়ে তেলো এবং সম্মিলিতভাবে সামাজিকসহ নানান পরিবেশগত সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসা। সংগঠনটি পরিচালিত হয় ১৩ সদস্য বিশিষ্ট পরিচালনা কমিটির মাধ্যমে।
সামাজিক সমস্যা সমাধানেও ভূমিকা রাখছে এই সংগঠনের সদস্যরা
প্রথমদিকে এই সংগঠনের সদস্যরা শুধুমাত্র পাখি রক্ষার ইস্যুতে একত্রিত হলেও সময় ও চাহিদার কারণেই বর্তমান তারা নানামূখী উদ্যোগ নিয়েছে। পরিবেশ সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যার পাশাপাশি তারা সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। এজন্য তারা পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখতে পরিচ্ছন্ন অভিযান, সমাজে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে পরিবারে পরিবারে প্রচারণা ও সচেতনতা তৈরি, স্কুল পর্যায়ে আলোচনা ও মতবিনিময় করেন। এছাড়াও পুকুরের সুস্থ পরিবেশ রক্ষায় তারা পুকুরে পরিবেশবান্ধব উপায়ে মৎস চাষের প্রসার ও সকলের মধ্যে এই সচেতনতা প্রচারে কাজ করেন। শীতের সময় নিজেরা চাঁদা তুলে এবং বিভিন্ন সংগঠনের কাছ থেকে উপকরণ সংগ্রহ করে শীতবস্ত্র বিতরণ করেন দরিদ্র ও শীতার্ত মানুষের মাঝে। গ্রামের মানুষের ভিজিএফ, ভিজিডি কার্ডসহ নানা অধিকার আদায়ে সহযোগিতা করেন তারা। এছাড়াও ফসল চাষে জৈব পদ্ধতির প্রসারেও নানাভাবে প্রচার-প্রচারণা করছেন তারা। এই প্রসঙ্গে সংগঠনটির সক্রিয় সদস্য নাসির উদ্দিন বলেন, “কৃষকের ক্ষেতের পোকা খেয়ে পাখি কৃষক এবং ফসলকে রক্ষা করে, আমরা নিজেরা নানা ধরনের জৈবসার এবং জৈববালাই তৈরি করি, ব্যবহার করি এবং সম্প্রসারে কাজ করে যাচ্ছি।” তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় কাঞ্জন গ্রামের বিলকে পাখিদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র হিসেবে ঘোষণা করতে সফল হয়েছেন। বর্তমানে সেখানে কেউ আর পাখি শিকার করতে পারে না। বিলটিতে বর্তমান শীতের অতিথি পাখির সংখ্যা দিনে দিনে বেড়ে যাচ্ছে।
সংগঠনের সদস্যদের স্বপ্ন
সংগঠনের সদস্যরা স্বপ্ন দেখেন তাদের গ্রাম পাখি প্রজননের নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে গড়ে উঠছে। এলাকায় জলাশয়গুলো স্বাস্থ্যসম্মত এবং পরিবেশবান্ধব উপায়ে মৎস চাষ হচ্ছে। গ্রামের খাসপুকুরগুলো দখলমুক্ত হয়ে সামাজিকভাবে মৎসচাষ হচ্ছে যা, যুবকদের কর্মসংস্থান তৈরিতে ভূমিকা রাখছে। তারা স্বপ্ন দেখেন, পরিবেশ, বন্যপ্রাণী এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও রক্ষা বিষয়ে কর্মরত বিভিন্ন ধরনের সকারি ও বেসরকারি সংগঠনের সাথে তাদের যোগাযোগা ও যৌথ উদ্যোগ তৈরি হচ্ছে। এলাকার নদী রক্ষা, খনন এবং দখল, দুষণ প্রতিরোধে সবার সম্মিলিত উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। তারা স্বপ্ন দেখেন, তাদের এই উদ্যোগে অনুপ্রাণীত হয়ে অন্যান্য এলাকার তরুণরাও পরিবেশসহ নানান সামাজিক সমস্যা সমাধানে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখছে। নওগাঁর তরুণদের এই স্বপ্নের সাথে শামিল হয়ে আসুন আমরাও একটি সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ গড়ে তোলার যা যা করা দরকার তা স্ব স্ব অবস্থান ও ক্ষমতা থেকে করার উদ্যোগ নিই।